বিপদে পরিবেশ সাংবাদিক

বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সাংবাদিকরা আরো বেশি হিংসার সম্মুখীন হচ্ছে

বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সাংবাদিকরা ক্রমশ আরো বেশি করে হিংসার সম্মুখীন হচ্ছে। গত ৩ মে, প্রেস ফ্রিডম ডে (সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা দিবস) উপলক্ষে ইউনেস্কোর প্রকাশিত একটি নতুন রিপোর্টে এ কথা বলা হয়েছ। রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে ৪৪ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছে। এর মধ্যে সব থেকে বেশি পরিবেশ সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। এই অঞ্চলে ৩০ জন এবং ল্যাটিন আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে ১১ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে।

‘প্রেস অ্যান্ড প্ল্যানেট ইন ডেঞ্জার’ নামে এই রিপোর্ট অনুযায়ী, ১২৯টি দেশের মোট ৯০৫ সাংবাদিক এবং মোট সমীক্ষা করা সংস্থার ৭০ শতাংশেরও বেশি সংস্থা জানিয়েছে যে, তাদের উপর হামলা, হুমকি বা চাপ দেওয়া হয়েছে পরিবেশ সাংবাদিকতা করার জন্য। রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়েছিল চিলির সান্তিয়াগোতে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে গ্লোবাল কনফারেন্সে।

রিপোর্টটিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে হিংসার সংখ্যা বেড়েছে। আর খুব নির্দিষ্টভাবে বললে ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে মোট ৩০৫টি আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিশ্বের সব অঞ্চলের পরিবেশ সাংবাদিকরা বছরে গড়ে ৫০টি হামলার সম্মুখীন হয়েছেন।

দুঃখের বিষয় হলেও একথা সত্যি যে, এই আক্রমণগুলি রাষ্ট্রযন্ত্র যেমন পুলিশ, সামরিক বাহিনী, সরকারি আধিকারিক এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষর থেকেই বেশি হয়েছে। বিভিন্ন দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ, সরকারি সহায়তায় কর্পোরেটগুলি যে লুঠ চালাচ্ছে, সে বিষয়ে বিভিন্ন খবরাখবর মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্যই এই আক্রমণ নেমে এসেছে। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বিভিন্ন দেশের সরকারের তরফে হামলা হয়েছিল ১১১ টি। ২০১৯ থেকে ২০২৩ এর মধ্যে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭৪টি। হামলার প্রকৃতির মধ্যে রয়েছে শারীরিক হামলা, হয়রানি, নির্বিচারে আটক, ফৌজদারি অভিযোগ, কারাদণ্ড, মানহানি ইত্যাদি।

হামলার শিকার সাংবাদিকরা প্রধানত পরিবেশগত প্রতিবাদ, খনি, ভূমি সংঘাত, বন উজাড়, চরম আবহাওয়ার ঘটনা, দূষণ, জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্প এবং পরিবেশের ক্ষতির বিষয়ে প্রতিবেদন করছিলেন। যারা পরিবেশ নিয়ে প্রতিবাদ, খনি এবং ভূমি নিয়ে সংঘাতের ওপর সংবাদ পরিবেশন করছে— তারা সব থেকে বেশি আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যারা নিহত হয়েছে, তারা খনি, বন উজাড় এবং ভূমি সংঘাত নিয়ে বেনজির ঘটনা মানুষে সামনে নিয়ে এসেছিল। যে সব সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে মাত্র ৫টি মামলায় দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া গেছে।

ইউনেস্কো এবং ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্ট যৌথভাবে সমীক্ষা করে এই রিপোর্টটি তৈরি করেছিল। তারা দেখেছে যে, পরিবেশ নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, নানা চাপে সম্পাদকেরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট সেন্সার করে। সমীক্ষায় ৩৩ শতাংশ সাংবাদিক ইঙ্গিত দিয়েছেন, সরকার এবং কর্পোরেটের স্বার্থে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। আবার প্রায় ৪৫ শতাংশ সাংবাদিক, পরিবেশ নিয়ে খবরাখবরে উৎসাহী হলেও, সে সব নিয়ে নিজে থেকেই কোনো রিপোর্ট করেনি। কেন তারা করেনি, তা সহজেই অনুমেয়।

বিভিন্ন দেশের সরকার ও তার ব্যবস্থা, রাজনৈতিক দল এবং কর্পোরেটের যোগসাজশে পরিবেশ-প্রকৃতির যে সার্বিক লুঠ চলছে তা ঠেকাতে পরিবেশ সাংবাদিকতা আজকের দিনে খুবই জরুরি। জলবায়ু বদল এবং অন্যান্য আরো পরিবেশ সংকট, জীব বৈচিত্রের সংকট নিয়ে সচেতনতা এবং জনমত গঠনের জন্য পরিবেশ সাংবাদিকতা অপরিহার্য।

রিপোর্টটিতে জোর দেওয়া হয়েছে, পরিবেশগত সংকটের ফলে মানুষসহ জীব জগতের অস্তিত্ব বিলোপের মুখে। তাই পরিবেশ সাংবাদিকতাকে গুরুত্ব দিতেই হবে। এ জন্য তামাম অ্যাডভোকেসি গ্রুপ, সাংবাদিকতা নেটওয়ার্ক, দাতা, বহুপাক্ষিক সংস্থা এবং অন্যান্য সহভাগীদের নিয়ে একটি মঞ্চ তৈরি করা দরকার। এই মঞ্চ পরিবেশ সাংবাদিকতা নিয়ে কর্মরত সাংবাদিক এবং সংস্থার স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তা এবং তাদের কাজের জন্য অর্থ এবং প্রয়োজনীয় সহায়তার উপর জোর দেবে।

মে - ২৪, ২৯-৬৯, পরিবেশ, সাংবাদিকতা

Comments

Popular posts from this blog

লিঙ্গসাম্যের দিকে এগোচ্ছে দেশ

পারম্পরিক জ্ঞানের তথ্যায়ন

দাঁতের ব্যথায় লবঙ্গ