জলবায়ু বদল ও ন্যায়ের প্রশ্ন

জলবায়ু বদল যে দ্রুত হচ্ছে এটা এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। অস্বীকার করা যাচ্ছে না যে, এর জন্য বাজার অর্থনীতি এবং তার কারিগর কর্পোরেটগুলি দায়ী লিখছেন সুব্রত কুণ্ডু


এই যে বড় বড় পরিবেশ সম্মেলন হচ্ছে তার পৃষ্ঠপোষক কারা? মানে কারা টাকা জোগাচ্ছে? জানেন? ধরুন জলবায়ু বদল নিয়ে গ্লাসগোর (কনফারেন্স অব পার্টিস বা কপ-২৬) সম্মেলন। টাকা দিলো কারা— মাইক্রোসফট, ইউনিলিভার, হিটাচি, গ্ল্যাক্সো-স্মিথক্লাইন, জাগুয়ার-ল্যান্ড রোভার এবং আইকিয়ার মতো প্রায় ডজন খানেক দৈত্যাকার কোম্পানি— যাদের আমরা কর্পোরেট বলে জানি। তারপর হল কপ-২৭। ২০২২-এর নভেম্বরে। মিশরের শার্ম আল শেখ শহরে। এখানে টাকা দিল ১৮টি কোম্পানি। কোকাকোলা, সিমেন্স, আইবিএম, গুগুল, সোডিক, সিসকো, এর মধ্যে কয়েকটি নাম। প্রতি সম্মেলনেই একটি করে গ্রিন কর্নার থাকে। যেখানে পৃথিবী বাঁচাতে বিভিন্ন নতুন নতুন প্রযুক্তি, ব্যবস্থা, সম্ভাবনার প্রদর্শনী করে এই কর্পোরেটগুলি। কর্নার বললেও, পরিবেশ সম্মেলনগুলির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু এই জায়গাটি। এতো ভালো কথা! সবাই মিলে উদ্যোগ নিলে তবেই তো আমরা জলবায়ু বদল রুখে দিতে পারব।

কিন্তু এত ভালোও কি ভালো? মুনাফাবাজ কর্পোরেটদের ধান্দাটা অন্যখানে। জলবায়ু বদল যে হচ্ছে এটা এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। অস্বীকার করা যাচ্ছে না যে, এর জন্য বাজার অর্থনীতি এবং তার কারিগর ওই কর্পোরেটগুলি দায়ী। তবে পরিবেশ সম্মেলনে টাকা ঢেলে তারা তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত নয়, ধান্দার ধনতন্ত্রের বিকাশ ঘটাতে চাইছে। দিনের পর দিন প্রকৃতি পরিবেশ লুঠে নেওয়া কর্পোরেটগুলি এখানেও তাদের ধান্ধা খুলে বসেছে মুনাফার জন্য।

জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে গ্লাসগোর সম্মেলন (কপ-২৬)-এ ১৩০ ট্রিলিয়ন ডলারের তহবিলের তৈরির কথা হয়েছে। এর সিংহভাগই যাতে কার্বন নির্গমন কমানোর কাজে ব্যবহার হয়, তার জন্য দেশ নেতা ও ধান্দাজীবীরা লাফিয়ে পড়েছে। সে জন্যই কার্বন নির্গমন কমানোর প্রযুক্তি নিয়েই গ্রিন কর্নারে প্রদর্শনী চলেছে, ভবিষ্যতে বড় ব্যবসার সুযোগ তৈরি করতে।

কেতাবি ভাষায় জলবায়ু বদল ঠেকাতে দুই ধরনের উদ্যোগ দরকার এক, মিটিগেশন— বাংলায় প্রশমন, নিরসন বা কমানো। কি কমানো হবে? গ্রিনহাউস গ্যাস। নির্দিষ্টভাবে কার্বন ডাই অক্সাইড। আর দুই, অ্যাডাপটেশন— বাংলায় অভিযোজন, অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া বা খাপ খাইয়ে নেওয়া। জলবায়ু বদল হবেই— এ কথা মাথায় রেখে, নিজেদেরকে তার সঙ্গে মানিয়ে বেঁচে থাকা। এই দুই উদ্যোগের মধ্যে কোনটি বেশি জরুরি তা নিয়ে চলছে জোরদার বিতর্ক। কর্পোরেট এবং তাদের সহযোগীরা চাইছে, ওই অর্থের বেশিরভাগটা ব্যবহার হোক নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং তার প্রসারের কাজে। যাতে তাদের মুনাফায় কোনো ছেদ না পড়ে। আর মুলত বিকাশশীল দেশগুলি চাইছে, জলবায়ু বদলের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ যাতে এই বদলের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, তার জন্য অর্থ বরাদ্দ হোক।

এই দুই ধরনের উকিলরাই কিন্তু চলতি উন্নয়ন ব্যবস্থার পক্ষে। ভাবটা এমন যেন নতুন প্রযুক্তি এলে বা মানুষ মানিয়ে নিতে শিখলে, জলবায়ু বদল রুখে দেওয়া যাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, প্রকৃতিকে লুঠে নেওয়া শিল্প সভ্যতা এবং লাভ ও লোভের সংস্কৃতিকে কেউ প্রশ্ন করছে না। জলবায়ু বদলকে ঘিরে থাকা ন্যায়ের প্রশ্নটিও এখানেই লুকিয়ে রয়েছে, যা বুঝতে কিছু তথ্য দেখে নেওয়া যাক—
  • গত ৭০ বছরে পৃথিবীর উষ্ণতা ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এই বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রিতে পৌঁছলেই তা বিশ্বের জলবায়ু আর পরিবেশকে মানুষের বসবাসের অযোগ্য করে তুলবে।
  • ২০২০ সালে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের মাত্রা ছিল প্রায় ৩৮ গিগাটন (কোভিডের কারণে এবছর আর্থিক কাজ প্রায় বন্ধই ছিল)—
  • তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ২১০০ সালে ১.৫ ডিগ্রিতে বেঁধে রাখতে গেলে ২০৩০-এর মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হওয়া উচিত ১৮.২২ গিগাটন। অর্থাৎ আট বছরের মধ্যেই, গ্রিনহাউস গাসের পরিমাণ ২০ গিগাটন কমিয়ে আনতে হবে। আর একই সঙ্গে, এই হার ধরে রাখতে হবে।
  • ভারতে বছরে মাথাপিছু গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ১.৮ মেট্রিক টন, যেখানে আমেরিকার ১৫.২ মেট্রিক টন। চিনের মাথাপিছু নির্গমন ৭.৪ মেট্রিক টন।
  • সারা পৃথিবীতেই ধনীদের গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন একই রকম— তা তাঁরা যে দেশেই থাকুন না কেন।
  • সামগ্রিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ৫২ শতাংশের জন্য দায়ী পৃথিবীর ৯ শতাংশ ধনী মানুষ— যারা সংখ্যায় মাত্র ৬.৫ কোটি। এর মধ্যে আবার এক শতাংশ ধনী, সামগ্রিক নির্গমনের ১৫ শতাংশের জন্য দায়ী।
  • পৃথিবীর মাত্র একশোটি বড় কোম্পানি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ৭১ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের জন্য দায়ী।
সুন্দরবনের মৌসুনি দ্বীপ। ২০০৯-এর আয়লা ঘূর্ণিঝড়ের পরেও এই দ্বীপের নদীর একদম ধারের একটি অংশে বাস করত কিছু হত দরিদ্র পরিবার। কিন্তু ২০২১-এ গিয়ে তাদের কোনো হদিস পায়নি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। তাদের বক্তব্য, নিরন্তর ছোট, বড় নানা ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপে ভিটে-মাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে এই পরিবারগুলি। অধ্যাপক সুগত হাজরার নেতৃত্বে এই সমীক্ষা হয়েছিল।

ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ তাদের বেশ কয়েকটি রিপোর্টে উল্লেখ করেছে ভারত ও বাংলাদেশের সুন্দরবন অঞ্চলে বসবাসকারী প্রায় ২ কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছে জলবায়ু বদলের কারণে।

এক নামী দাতা সংস্থার সমীক্ষায় দেখা গেছে, দিল্লি শহরে বসবাসকারী শ্রমিকেরা তীব্র গরমের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে অসহ্য দাবদাহের ফলে ঘরদোর ঠাণ্ডা করার জন্য তাদের মধ্যে ওয়াটারকুলার ব্যবহার বাড়ছে। বিদ্যুতের বিল বাড়ছে। অর্থাৎ গরম বাড়ার ফলে, এক দিকে তাদের আয় কমছে। অন্যদিকে খরচও বেড়ে যাচ্ছে।

কাউন্সিল অন এনার্জি, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ওয়াটার সংস্থার সমীক্ষা বলছে, উষ্ণায়নের কারণে বাড়বে গরম। তার জন্য বাড়াতে হবে বিদ্যুতের উৎপাদন। আর নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজন হবে ২ লক্ষ কোটি টাকার ওপর বিনিয়োগের।

উদাহরণের কোনো শেষ নেই। পৃথিবীর জলবায়ু বদলে যাদের কোনো ভূমিকা নেই। যারা প্রকৃতি বা পরিবেশ বাঁচানোর লড়াই প্রতিদিন করে চলেছে, তারাই বঞ্চিত হচ্ছে বেঁচে থাকার ন্যূনতম সুযোগ সুবিধা থেকে। তাদের ভিটে মাটি চাটি হয়ে যাচ্ছে। শিল্প সভ্যতা, লাভ ও লোভের অর্থনীতি-সংস্কৃতি এবং সম্পদশালীদের কাণ্ডজ্ঞানহীনতার ফল ভুগছে প্রকৃতি, পরিবেশ আর পৃথিবীর নব্বই ভাগ মানুষ। তাই ধান্দার ধনতন্ত্রের বদলে ন্যায়ের প্রশ্নটি জলবায়ু বদল রোখার জন্য সবথেকে জরুরি। চলতি শিল্প সভ্যতা এবং লাভ ও লোভের সংস্কৃতিকে রেখে ন্যায় এবং নৈতিকতার প্রশ্নটিকে গুরুত্ব দেওয়া অসম্ভব, কারণ এই সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরতে পরতে লুকিয়ে রয়েছে অন্যায়। প্রকৃতি, পরিবেশ শোষণের ইতিহাস।

মার্চ - ২৩, ২৮-৫০, জলবায়ু বদল, ন্যায়

Comments

Popular posts from this blog

লিঙ্গসাম্যের দিকে এগোচ্ছে দেশ

পারম্পরিক জ্ঞানের তথ্যায়ন

দাঁতের ব্যথায় লবঙ্গ