সরষের ভূত
প্রকৃতি, পরিবেশের ওপর প্রভাব বিচার না করেই জিন পরিবর্তিত সরষে চাষের অনুমোদন দিল কেন্দ্র লিখছেন সুব্রত কুণ্ডু
অবশেষে, পরিবেশ মন্ত্রকের অধীনে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাপ্রাইজাল কমিটি ১৮ অক্টোবর পরীক্ষা ও প্রদর্শনের জন্য ধারা সরষে হাইব্রিড-১১ (DMH-11) বীজের পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়ার পর, কেন্দ্রীয় সরকার ৫টি রাজ্যে জিএম সরষের চাষের অনুমোদন দিয়েছে। রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এবং হরিয়ানার চাষিরা এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে, ৮ নভেম্বরে এই ফসল প্রত্যাহারের দাবিতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে একটি পিটিশন সুপ্রিম কোর্টে জমা পড়েছে। কোর্ট সে মামলা গ্রহণ করে প্রথমে ১০ এবং পরে ১৭ নভেম্বর অবধি সরকারের এই সিদ্ধান্তের ওপর স্থগিতাদেশ জারি করেছে। সচেতন চাষি, স্বেচ্ছাসেবী, পরিবেশ কর্মী, বিজ্ঞানীরা জিএম ফসল একেবারে বয়কটের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে বহুদিন ধরেই।
প্রকৃতি থেকে দূরে, ল্যাবরেটরিতে বিভিন্ন জটিল প্রক্রিয়ায়, জিন ফসল তৈরি করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় কোনো একটি জীবের নির্দিষ্ট গুণ সম্পন্ন জিন, সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ফসলের জিন সারণিতে বসিয়ে দেওয়া হয়। এতে ওই নির্দিষ্ট গুণ ফসলেও দেখা যায়। এখানে উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বিটি তুলোর কথা। ব্যাসিলাস থুরিনজিয়েনসিস একটি ব্যাকটেরিয়া যা বিটি টক্সিন তৈরি করে। এই টক্সিন তুলোর বোল ওয়ার্ম নামের পোকা প্রতিরোধ করে। তাই বিটি’র ওই জিন তুলোর জিন সারণিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। নাম দেওয়া হল বিটি তুলো। বলা হল, এই তুলো চাষ করলে পোকামাকড় লাগবে না। কীটনাশকের খরচ কমবে। চাষির লাভ বেশি হবে। পরে দেখা গেল এসবই বাগাড়ম্বর। কোম্পানির মুনাফার হাতিয়ার। এছাড়া জিএম উদ্ভিদ প্রকৃতিজাত নয়। তাই এই রবাহূত ফসলের কী প্রভাব প্রকৃতিতে পড়বে তা কেউ জানে না।
তবে এবারের বিরোধিতা এক অন্য মাত্রা পেয়েছে মৌমাছিপালক বা মৌচাষিদের আন্দোলনে। রাজস্থানের ভরতপুরে ইণ্ডিয়ান কাউন্সিল অব এগ্রিকালচার রিসার্চ (আইসিএআর)-এর সরষে রিসার্চ ইনস্টিটিউটে মৌচাষিরা কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে। তাদের কথায়, হাইব্রিড বীজ এবং বিটি-তুলোর চাষ ইতিমধ্যেই মৌমাছি এবং মধু উৎপাদনকে প্রভাবিত করেছে। আর জিএম সরষে চালু হলে মৌমাছির সংখ্যা একেবারে কমে যাবে। তাদের আরো বক্তব্য, সরষেই একমাত্র প্রাকৃতিক ফসল যার উপর এখন মৌচাষিরা নির্ভর করে। আগে তারা প্রায় আট মাস মধু সংগ্রহ করত। এখন তিন মাসও পাওয়া যায় না। নতুন দিল্লি থেকে প্রকাশিত ডাউন টু আর্থ এই কথা লিখেছে তাদের ওয়েবসাইটে। মৌপালন ও মধুর জন্য চাষিরা সাধারণত সূর্যমুখী, তুলো, জোয়ার, বাজরা, ভুট্টা, তিল, অড়হর, ছোলা ইত্যাদি ফসলের ওপর নির্ভর করত। কিন্তু এইসব ফসলের জন্য এখন হাইব্রিড বীজ ব্যবহার হচ্ছে। এর জন্য ফুলের দিনের সংখ্যা কমেছে। এতে মৌমাছির সংখ্যা এবং মধুর উৎপাদনও কমেছে। আন্দোলনকারী চাষিদের কথায় তাদের মধু আহরণের মরসুম এখন বছরে তিন মাসেরও কম হয়ে গেছে।
উল্লেখ্য, ভারত একটি প্রধান মধু রফতানিকারী দেশ। আর সব থেকে বেশি উৎপাদন এবং রফতানি হয় সরষের মধু। মৌচাষিরা বলছেন, বিটি-তুলো চাষে মধু উৎপাদন কমেছে। আগে যেখানে তুলোর মরসুমে দুইবার মধু সংগ্রহ হত। এখন একবার হয়। জিএম সরষের ক্ষেত্রেও এ ঘটনা ঘটবে না এটা কে বলবে! আর তাই মৌমাছির জনসংখ্যার উপর বৈজ্ঞানিক প্রভাব না জেনে সরকার কীভাবে একটি জিএম ফসল অনুমোদন করতে পারে।
ভারতে প্রায় ২০ কোটি মৌমাছির কলোনি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে যা ফলন বাড়াতে সাহায্য করে এবং জীবিকার সংস্থান করে। প্রায় ২৫ লক্ষ্য চাষি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য মৌমাছির উপর নির্ভরশীল। জিএম সরষে চাষের ফলে মৌপালন সরাসরি প্রভাবিত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছে অনেকেই।
ভারত থেকে যে মধু রফতানি হয় তার প্রায় সবটাই সরষের মধু। এই মধু দ্রুত জমে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলিতে সরষের মধু খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু তারা জিএম-মুক্ত মধু চায়। আর তাই জিএম সরষে চাষ বাণিজ্যিকভাবে অনুমোদিত হলে দেশে মৌপালন প্রায় বন্ধই হয়ে যেতে পারে।
নভেম্বর - ২২, ২৮-২৩, কৃষি, জিএমও
Comments
Post a Comment