কৃষি, চাষিদের সংস্থা আর লুঠ

চাষিদের এক জায়গায় করো। হাজার চাষির ফসল এক জায়গা থেকে কেনো। কম দামে কেনো। মুনাফা বাড়াও। এই হল চাষিদের কোম্পানি তৈরির মূল কথা। 
লিখছেন  সুব্রত কুণ্ডু

কৃষি আইন বাতিল করতে হবে। যুক্তিযুক্ত দাবী। আর্থিকভাবে দুর্বল ছোট এবং প্রান্তিক চাষি। তাদের শেষ জীবিকাটুকু কেড়ে নিতে চায় সরকার। একাজে তার দোসর কর্পোরেট। তিনটি কৃষি আইন হাতিয়ার করে। সব সরকারই চায় কৃষি থেকে হাত তুলে নিতে। এতে ভরতুকি কম দিতে হয়। দায়ও কমে। কর্পোরেট চায় হাতে তুলে নিতে। কারণ নানা খাতে প্রচুর ভরতুকি বাড়ে। সরকার কম সুদে প্রচুর ঋণ দেয়। সরকারি ঋণ শোধ না করলে ক্ষতি নেই। ব্যাংক খাতায় ‘বাজে ঋণ’ বলে তা লেখা হয়ে যায়। পরে তা বাতিলের খাতায় চলে যায়। সব মিলিয়ে একচেটিয়া ব্যবসাও বাড়ে। বিভিন্ন দেশে এ ঘটনাই ঘটছে। এসবের মধ্যে চাষি কার্যত বড় কৃষি ব্যবসার শ্রমিক হয়ে পড়ে। তাই তিনটি কৃষি আইন নিয়ে এত বিরোধ।

কৃষির কর্পোরেটকরণের আরেক হাতিয়ার হল চাষিদের কোম্পানি তৈরি। এর পোশাকি নাম ফার্মার প্রোড্যুসার অর্গানাইজেশন বা এফপিও। কেন্দ্র সরকার আর নাবার্ড উঠে পড়ে লেগেছে এফপিও তৈরিতে। রাজ্যও পিছিয়ে নেই। আইন শুধরে নেওয়া হয়েছে। কিছু এনজিও আর অসরকারি সংস্থা এর প্রোমোটার। বিশ্বব্যাংক তাদের নিজস্ব এই মডেলে পয়সা ঢালছে। পয়সা ঢালছে এনজিওদের দাতা সংস্থাগুলিও। উদ্দেশ্য নাকি চাষিদের সংগঠিত করা। চাষের সামগ্রী এবং উৎপাদিত ফসল কেনাবেচার ক্ষেত্রে তাদের দরদাম করার ক্ষমতা বাড়ানো। ধরে নেওয়া হচ্ছে, এতে চাষির শক্তি এবং আয় দুইই বাড়বে। আখেরে কি তাই হবে?

মনে হয় না। এর মূল উদ্দেশ্য একদম অন্যরকম। এদেশে ক্ষুদ্র এবং প্রান্তিক চাষি ৮৬.২ শতাংশ। রাজ্যে ৯৬ শতাংশ। সমীক্ষা বলছে, সারা পৃথিবীতেই এই চাষিরা অন্যদের তুলনায় বেশি ফসল ফলায়। ভারতের ছোট এবং প্রান্তিক চাষিও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু উৎপাদনশীলতা বেশি হলে কি হবে, এদের ঘরে ঘরে গিয়ে ফসল কেনা কর্পোরেটের পোষায় না। খরচ অনেকে বাড়ে। তাই এফপিওর অছিলা। চাষিদের এক জায়গায় করো। হাজার চাষির ফসল এক জায়গা থেকে কেনো। কম দামে কেনো। মুনাফা বাড়াও।

সবুজ বিপ্লবের সঙ্গে এসেছিল একক চাষ। দানা শস্যের ক্ষেত্রে এই একক চাষ সারা দেশে ছড়িয়েছে। আর কিছু এলাকায় জমি অনুযায়ী অন্য কিছু ফসলের একক চাষ হয়। অন্ধ্র ও তেলেঙ্গানায় তুলো, মহারাষ্ট্রে আখ আর পেঁয়াজ। আমাদের রাজ্যে আলু ইত্যাদি। কিন্তু এদেশের জল হাওয়ায় এত বৈচিত্রময় ফসল হয় তা সারা পৃথিবীতে কোথাও হয় না। এই বৈচিত্র্ প্রকৃতি-পরিবেশের জন্য জরুরি। আর বৈচিত্র টিকে আছে ছোট চাষিদের জন্যই। এই ফসলের চাহিদা স্থানীয়ভাবে আছে। তাই চাষি ফলায়। কিন্তু কর্পোরেট তো দশ রকম বেগুন, সাত রকমের সিম, পাঁচ রকমের লঙ্কা কিনবে না। তারা তো বিশ্ববাজারে ফসল বেচতে চায়। সেখানেতো এত সবের চাহিদা নেই। বৈচিত্র নিয়ে তাই তারা কি করবে, বাজারে তার যদি চাহিদা না থাকে !

তারা জানে লঙ্কার থেকে রঙবেরঙের ক্যাপসিকামের কাটতি অনেক বেশি। ছোট, বড়, মাঝারি জাতের টম্যাটো প্যাকিং করতে অসুবিধা। তাই লম্বা ও কিছুটা চৌকো মাপের, বীজ কম টম্যাটো চাই। এভাবেই একই মাপের আলু চাই - ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই তারা জমি এবং জল শোষণ করে ওইসব ফসল চাষ করতে চাষিদের উৎসাহ দেবে। বীজ ,সার, বিষ নিজেরাই দেবে। এসব করা হবে এফপিওদের সঙ্গে চুক্তি করে। হাজার চাষির থেকে দুই একজন কর্তাকে বোঝানো সহজ। ঘুষ দেওয়াও সহজ। এতে মাটি, জল, পরিবেশ, বৈচিত্র্ চুলোয় গেলে যাক।

দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, যারা কৃষি আইনের বিরোধিতা করছে, তারা এফপিও নিয়ে চুপ। কিছু সংস্থা তো এর প্রচারক, প্রসারক। তারা ভাবছে এতে চাষিদের সক্ষমতা বাড়বে। ঘোড়ার ডিম। সহজ সত্যি কথাটা হল, যেন তেন প্রকারেণ মুনাফাই কর্পোরেটের এক এবং অদ্বিতীয় লক্ষ্য। অন্য কিছু নয়। ভেবে দেখুন। উদাহরণ আশেপাশে অনেকই আছে…।
মতামত লেখকের নিজস্ব 

অগস্ট -২১, ২৭-১৩ চাষ, এফপিও

চাষিদের সংস্থা সম্পর্কে আরো জানুন

Comments

  1. অসাধারণ বিশ্লেষণ। এই চোখ খোলার জ্ঞান টা থাকা খুব জরুরী।ধন্যবাদ।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

লিঙ্গসাম্যের দিকে এগোচ্ছে দেশ

পারম্পরিক জ্ঞানের তথ্যায়ন

দাঁতের ব্যথায় লবঙ্গ