অ্যানথ্রোপসিন মহামারি ও আগামী পৃথিবী

পৃথিবী বদলে যাচ্ছে। আমাদের চারপাশে জীব ও জড়ের পরস্পরের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকার ভূতাত্ত্বিক পর্ব হল হলোসিন। ১১ হাজার ৭০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই হলোসিন পর্ব গড়ে উঠেছিল। তথাকথিত আধুনিকতার নামে মানুষকেন্দ্রিক ভোগবাদে ভর করে আমরা একটি নতুন ভূতাত্ত্বিক যুগ – অ্যানথ্রোপসিন-এ প্রবেশ করেছি। অপরিসীম প্রকৃতি শোষণের এই যুগের প্রভাব, বাস্তু ব্যবস্থা (ইকোলজি) এবং প্রতিবেশে সব জীব ও জড়ের ওপরই খুব প্রকট। জলবায়ু বদল থেকে শুরু করে নতুন নতুন রোগের আবির্ভাব এবং তার ফলে মহামারির প্রভাবে আমাদের টিকে থাকাই খুব ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।

নতুন এই পর্বে বিভিন্ন পরিবর্তনের সঙ্গে ক্ষুদ্র জীবাণু এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে সংক্রমিত হচ্ছে। এর ফলে নতুন নতুন মহামারির আবির্ভাব হচ্ছে। এক জীবের দেহ থেকে অন্য জীবের রোগ সৃষ্টিকারী এই প্রক্রিয়াকে জুনোসিস এবং রোগগুলিকে জুনোটিক রোগ বলা হয়। কোভিড-১৯ সহ সার্স, ইবোলা ইত্যাদি হল জুনোটিক রোগ, যা একের পর এক মহামারি ডেকে আনছে। যে কোনো জীবের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হল বংশবৃদ্ধি, আর অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদেরকে মানিয়ে নেওয়া।

অ্যানথ্রোপসিন পর্বে মানুষের ভোগের সব সীমারেখা উজাড় হয়ে গেছে। ফলে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যাপক লুন্ঠন চলেছে। প্রাকৃতিক সম্পদের শোষণ এখন অনিয়ন্ত্রিত আর্থিক পুঁজি তৈরির অস্ত্র। ফলে সব জীবকূলের জীবন নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়ছে। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জীবনের নিয়ম মতো, সব জীব বাঁচার তাগিতে পরিবর্তন করে নিচ্ছে নিজেদেরকে। সন্ধান করছে নতুন বাসস্থান। বংশবৃদ্ধির ক্ষেত্র, যা মহামারি ঘটাচ্ছে মানুষ সহ বিভিন্ন জীবের।

এই সব জীবাণুগুলি জীবনচক্র কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন। ফলে দ্রুত তারা নিজেদের নতুন পরিস্থিতির জন্য অভিযোজিত করে নিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোভিড-১৯ এর এখন একাধিক স্ট্রেন দেখা যাচ্ছে। এতে কোথাও কোথাও আতিমারির প্রভাব বাড়ছে। 

আর্নে নায়েস ডিপ ইকোলজির প্রবক্তা। ১৯৭৩ সালে তিনি এই তত্ত্ব উপস্থাপন করে বলেন, পৃথিবীটা পাখি, গাছ, মানুষ সবার। ভোগবাদের প্রবক্তারা বলে, এই ধারণা মানুষ আর উন্নয়ন বিরোধী। তারা বলে এ জগত মানুষেরই জন্য। আর তাই আরো বেশি বেশি করে প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণ ও লুন্ঠনে ছাড়পত্র দেওয়া চলতেই থাকে। 

এ দেশে করোনা অতিমারির সময়ে সরকার এমন সব আইন কানুন এনেছে তা এই লুঠে মুষ্টিমেয় কিছু পুঁজিপতিদের মৌরসিপাট্টা স্থাপন করারই নামান্তর। পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে আমারা কিছু শিখছি না। ফলে তথাকথিত উন্নতির সঙ্গে বেড়ে চলেছে মানুষের মনোজগতের সমস্যা। অপরিমিত ভোগ, ঈর্ষা, দ্বেষ, হিংসা, লোভ-লালসা ডেকে আনছে মহামারি, অনাহার, দুর্ভিক্ষের মতন বৃহৎ সামাজিক সমস্যা। ছোট ছোট পায়রার খোপে বন্দী থেকে মানুষ ক্রমশ বিচ্ছিন্নতার পাঠ নিচ্ছে। ফলে বাড়ছে মানসিক রোগ। এহেন পরিস্থিতিতে প্রকৃতি-পরিবেশ সংরক্ষণ, তার সংবর্ধন একমাত্র মুক্তির পথ। এক অদ্ভুত আঁধারে দাঁড়িয়ে এইভাবে কি একবার ভেবে দেখা যায়?

সুব্রত কুণ্ডু

এপ্রিল - ২১ ২৬-২১, জলবায়ু বদল, মহামারি

Comments

Popular posts from this blog

লিঙ্গসাম্যের দিকে এগোচ্ছে দেশ

পারম্পরিক জ্ঞানের তথ্যায়ন

দাঁতের ব্যথায় লবঙ্গ