নিরর্থক কৃষি বাজেট - সুব্রত কুণ্ডু

বাজেট পেশ হল ১ ফেব্রুয়ারি। বাজেট হল দেশের সম্ভাব্য আয় এবং ব্যয়ের আগামী এক বছরে লেখাজোখা। পরে, বছর ধরে বিভিন্ন কারণে হিসেবের নানারকম পরিবর্তন হয়। 
সেইসব কারণ এবং পরিবর্তনের বিবরণ নিয়ে বাজেটের ঠিক আগেই প্রকাশিত হয় চলতি বছরের আর্থিক সমীক্ষা। এই সমীক্ষা এবং বাজেটে নানা পরিসংখ্যান দেওয়া থাকে। 
ঠিক আগে বা বাজেট পেশের সময় সরকার পক্ষ, অর্থমন্ত্রী নানারকম ভালো ভালো কথা বলেন। সেগুলি কথার কথা। বাস্তবে পরিসংখ্যান দেখে, সেই সব সংখ্যার কাটাছেঁড়া করে, বাজেটের ভালোমন্দ বিচার করা দরকার। এ লেখায় সেভাবেই কৃষি বাজেট দেখে তা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। আর যেসব ক্ষেত্রে কোনো সংখ্যা নেই, সেই বিষয়গুলি এখানে উল্লেখ করা হয়নি। এছাড়া চাষের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলিও এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। মোটামুটিভাবে দেশের ত্রিশ লক্ষ কোটির বাজেটে, কৃষির জন্যে বরাদ্দ থাকে দেড় লক্ষ কোটি টাকা। গত বছর ছিল ১ লক্ষ ৫৪ হাজার কোটি টাকা। এবারের তথাকথিত ‘কৃষি বান্ধব’ বাজেটে তা কমিয়ে করা হয়েছে ১ লক্ষ ৩৮ হাজার কোটি।

অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট ভাষণে বারবার বলেছেন, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দিয়ে এ বছরে কত কত চাল, গম, ডাল কেনা হয়েছে। কিন্তু এইসব সংখ্যার সঙ্গে বাজেটের কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ এগুলি সরকার কেনেনি। কিনেছে ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া বা এফসিআই, ধার নিয়ে। আর এফসিআই কে সরকার যে সাহায্য দেয়, তাও এবছর কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।  

পিএম কিষান যোজনা, সরকারের একটি প্রধান প্রকল্প। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ২ হেক্টর অবধি জমি যে চাষিদের রয়েছে, তাদের ৩ কিস্তিতে বছরে ৬০০০ টাকা দেওয়া হয়। চলতি বছরে এই প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৭৫ হাজার কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থ বছরে তা কমিয়ে করা হয়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। যদিও এখনো সরকার অর্ধেক কৃষকের কাছেও পৌঁছতে পারেনি।

পিএম আশা, যার মাধ্যমে সরকার নিজে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপি দিয়ে ফসল কিনে নেয়। এক্ষেত্রে কখনো নির্দিষ্ট কিছু ফসলের জন্য অতিরিক্ত দাম দেয়। গত বছর এই খাতে বরাদ্দ ছিল ৫০০ কোটি টাকা। আর এবছর কত হয়েছে জানেন? ৪০০ কোটি টাকা।

চাষের বাজার বিষয়ক মার্কেট ইন্টারভেনশন স্কিম এবং প্রাইস সাপোর্ট স্কিম এর ক্ষেত্রে এবছর বরাদ্দ ছিল ২০০০ কোটি টাকা। এই অর্থের অর্ধেকও সরকার খরচ করতে পারেনি। ২০২১-২২ অর্থ বর্ষে এখাতে বরাদ্দ কমে হয়েছে ১৫০০ কোটি টাকা।

মাটির স্বাস্থ্য ও উর্বরতা প্রকল্পে চলতি বছরের যা বরাদ্দ করা হয়েছিল ২০২১-২২ সালেও একই রাখা হয়েছে।

২০২২ সালের মধ্যে চাষিদের আয় দ্বিগুণ করার কথা বলেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। এবারের বাজেট অধিবেশনে কৃষিমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষে কৃষক পরিবারের গড় আয় কত ছিল। মন্ত্রী বলেছিলেন, এই আয় সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। এছাড়া এই আয় কতটা বেড়েছে তার কোনো হিসেব আর্থিক সমীক্ষা বা বাজেটে উল্লেখ করা হয়নি। তবে বাজেটে বলা হয়েছে, যে সব ফসল ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে কেনা হয়, সেগুলির উৎপাদন খরচের দেড় গুণ বেশি দাম যাতে চাষিরা পায় তা নিশ্চিত করবে সরকার। ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের ক্ষেত্রে স্বামীনাথন কমিশন বলেছিল, ফসলের উৎপাদন খরচের সঙ্গে পারিবারিক শ্রম, জমির ভাড়া, বিমার খরচ ধরে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঠিক করার কথা। এই হিসেবে এখন ১ কুইন্টাল ধানের দাম হবে প্রায় তিন হাজার টাকা। তবে সরকার সেই হিসেবে ন্যূনতম দাম ঠিক করবে কিনা, তা বলা হয়নি।

দেশের গ্রামীণ পরিকাঠামোর খুবই দূরাবস্থা। এতে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষি। গ্রামীণ পরিকাঠামো নির্মাণে অগ্রাধিকার দেওয়া হলে দেশে ৬০ শতাংশ শ্রমিক লাভবান হত। লাভবান হত বহু প্রান্তিক এবং ছোট চাষি। কিন্তু সরকার এই ক্ষেত্রে কোনো নজরই দেয় না। এবছর গ্রামীণ পরিকাঠামো উন্নয়ন তহবিলের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি থেকে বাড়িয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। তবে মাথায় রাখতে হবে এটা তহবিল। তহবিল হলেই যে তা খরচ হবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই। কারণ এটা সরাসরি বরাদ্দ নয়। এক্ষেত্রে খরচ করতে হলে, প্রজেক্ট তৈরি, অনুমোদন, অর্থ বরাদ্দ ইত্যাদি করে কাজ করতেই অনেকটা সময় কেটে যায়। যার জন্য এইসব তহবিলের পরিমাণ বাড়লেও তা খরচ হয় না। 

আপনারা হয়তো জানেন, গত বছর বাজেট পেশের সময় ১ লক্ষ কোটি টাকার একটি এগ্রিকালচার ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফান্ড বা কৃষি পরিকাঠামো তহবিল গঠন করা হয়েছিল। এখনো অবধি সেই তহবিলের মাত্র ২৯৯০ কোটি টাকার প্রকল্পের চুক্তি হয়েছে। কোনো টাকা এখনো অবধি এইসব প্রকল্পের জন্য দেওয়া হয়নি। এর অর্থ হল, এক বছরে কোনো কাজ শুরুই হয়নি। এই তহবিল থেকে সরকার খরচ করেছে মোটে ২০০ কোটি টাকা যার মধ্যে বেশিরভাগটাই প্রশাসনিক খরচ। ২০২১-২২ অর্থ বছরে কৃষি পরিকাঠামো তহবিলে ৯০০ কোটিও টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।

কৃষি পরিকাঠামো নির্মাণ তহবিলে অর্থ সরবরাহের জন্য, মদ এবং আমদানি করা হয় এমন ফল, ডাল ইত্যাদির ওপর এই সেস বা উপকর বসানো হবে বলে এই বাজেটে প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এছাড়া পেট্রল ও ডিজেলে লিটার প্রতি যথাক্রমে আড়াই এবং চার টাকা হিসেবে এই সেস বসানো হবে। আমরা জানি, চাষে এবং কৃষিপণ্য পরিবহনে পেট্রল ডিজেলের অনেকটা ব্যবহার হয়। ফলে বোঝা যাচ্ছে চাষিদের পকেট কেটেই কৃষি পরিকাঠামো নির্মাণ তহবিলে অর্থ সরবরাহ হবে। গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো আর কি। 

২০২০-২১ অর্থবর্ষে খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বরাদ্দ হয়েছিল ৭৮ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু কোভিড অতিমারির কারণে সরকার ৩ লক্ষ ৪৪ হাজার কোটি খরচ করেছিল। এবছর এ খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ২ লক্ষ কোটি টাকা। কোভিড পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। আবার দ্বিতীয় খেপে সংক্রমণ বাড়তে পারে। ইতিমধ্যে যারা কাজকর্ম খুইয়ে ছিল, তাদের অনেকে কাজে ফেরেনি। তা সত্ত্বেও এই খাতে অর্থ বরাদ্দ কমানো হয়েছে।

চলতি অর্থ বছরে ১০০ দিনের কাজে বরাদ্দ ছিল ৬১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু লকডাউনের ফলে কাজ হারা শ্রমিকদের কাজ দিতে, একপ্রকার বাধ্য হয়েছিল ১ লক্ষ ১১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা খরচ করতে। এই টাকা দিয়ে ১০০ দিন নয় গড়ে ৪৫ দিন কাজ দেওয়া গেছিল। ২০২১-২২ বছরে এই প্রকল্পে বরাদ্দ হয়েছে ৭৩ হাজার কোটি টাকা।

আপনারা জানেন, ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পের মুলত কৃষি এবং গ্রামীণ পরিকাঠামো খাতে খরচ হয়। প্রায় সমস্ত অর্থনীতিবিদ বলছে, দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করতে গরীব, নিম্নবিত্ত, মানুষের হাতে অর্থ সরবরাহ জরুরি। একাজে ১০০ দিনের কাজ প্রকল্প একটি উপযুক্ত মাধ্যম। কিন্তু এই প্রকল্পে নাম মাত্র অর্থ বাড়ানো হয়েছে। অর্থশাস্ত্রীদের মতে, হাতে টাকা পেলে মানুষ তদের দরকারি সামগ্রী কিনবে। ফলে চাহিদা বাড়বে। শিল্প সেই চাহিদা পূরণ করতে উৎপাদন করতে শুরু করবে। এতে অর্থনীতির চাকা ঘুরতে শুরু করবে এবং বৃদ্ধি স্বাভাবিক হারে হবে। কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি।   

বাজেটে ২০২১-২২ অর্থবর্ষে ১৬.৫ লক্ষ কোটি টাকা কৃষি ঋণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। চলতি অর্থ বর্ষে এই পরিমাণ ছিল ১৫ লক্ষ কোটি টাকা। এটা ঠিকই চাষিরা এই ঋণ পায়। কিন্তু এই ঋণের বেশিরভাগটাই পায় কৃষি এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ে যুক্ত শিল্প এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। কারণ কৃষি ক্লিনিক, পরিকাঠামো, পরিবহন ব্যবস্থা, সংরক্ষণ, বাজার তৈরি – এসবই কৃষি ঋণের আওতায় চলে আসে। এজন্য ৪ শতাংশ হারে ১০০ কোটি টাকা অবধি ঋণ পাওয়া যায়। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হিসেব অনুযায়ী, শুধু মহারাষ্ট্রে ২০১৬ সালে ৬১৫টি অ্যাকাউন্টে ৫৮ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে।  

২০২১-২২ অর্থ বছরে ক্ষুদ্র কৃষিসেচ তহবিলের পরিমাণ বাড়িয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। চলতি বছরে এর পরিমাণ ছিল ৫ হাজার কোটি টাকা। 

জলবায়ু বদলের ফলে চাষে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এক্ষেত্রে কোনো বরাদ্দ করা হয়নি। গত কয়েক বছর ধরে জিরো বাজেট বা শূন্য খরচের প্রাকৃতিক চাষে সরকার জোর দিয়েছিল। এ নিয়ে এবারে কোনো কথাই নেই বাজেটে। চাষে মহিলাদের অংশগ্রহণ, বৈচিত্রময় চাষের প্রসারের মতো অন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও বাজেটে কোনো কথা বলা হয়নি।

কৃষিক্ষেত্রে যুক্ত সবাই মনে করে কৃষিতে আরো বিনিয়োগ দরকার। এর দাওয়াই হিসেবে সরকার তাই নতুন তিনটি আইন এনেছে। ‘মুক্ত’ বাজারের নাম করে, এর মাধ্যমে, চাষিদের হঠিয়ে মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ীর হাতে কৃষিক্ষেত্র তুলে দেওয়ার তালে রয়েছে সরকার। এনিয়ে মুখোমুখী দাঁড়িয়ে পড়েছে সরকার এবং চাষিরা। এই বিরোধ কোন দিকে যায়, তার ওপরই নির্ভর করবে দেশের চাষের ভবিষ্যৎ বাজেট।

সূত্রঃ পিআইবি, স্বরাজ ইন্ডিয়া, মতামত ব্যক্তিগত

ফেব্রুয়ারি - ২১ ২৬-০৮, বাজেট, কৃষি

Comments

Popular posts from this blog

লিঙ্গসাম্যের দিকে এগোচ্ছে দেশ

পারম্পরিক জ্ঞানের তথ্যায়ন

দাঁতের ব্যথায় লবঙ্গ