শিক্ষাঃ আত্মঘৃণা তৈরির আঁতুড়ঘর

আধুনিক ফ্যাক্টরি স্কুলিংয়ের লুকানো পাঠ্যক্রমের আসল অ্যাজেন্ডা হল: আত্ম-ঘৃণা তৈরি লিখছেন মনীশ জৈন


আমার এমন অনেক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়, যারা বীরত্বের সঙ্গে সব ধরনের নতুন নতুন পাঠ্যক্রম এবং চকচকে প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সংশোধন বা সংস্কার করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তারা স্কুলে পড়ার আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারছে বলে অন্তত আমার মনে হয় না। যে কোন ব্যবস্থায় আধিকারিক নিয়ম এবং লক্ষ্য থাকে যা প্রায়ই অনেক বড় বড় শব্দ যেমন সত্য, সমতা, গণতন্ত্র, প্রগতি ইত্যাদি দিয়ে বোঝানো হয়। বিশ্বজুড়ে আধুনিক ফ্যাক্টরি স্কুলিংয়ের লুকানো পাঠ্যক্রমের আসল অ্যাজেন্ডা হল: আত্ম-ঘৃণা তৈরি। 'আমি যথেষ্ট ভালো নই' ক্রমাগত এই অনুভূতি প্রচার এবং তা পড়ুয়াদের মধ্যে চারিয়ে দেওয়া।

বেশিরভাগ পড়ুয়ারা তাদের প্রতিভা এবং ক্ষমতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। তাদের উচ্চাশা এবং স্বপ্ন সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।এই অ্যাজেন্ডার ফলে পড়ুয়াদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের 'ব্যর্থ' বলে বিশ্বাস করে এবং দিশাহীন হয়ে পড়ে।

এই অবস্থা ভোগবাদ, ঔপনিবেশিকতা এবং দ্বন্দ্বের ইন্ধন জোগায়। এছাড়াও ব্যবস্থাটিতে— নম্বর, ডিপ্লোমা, কতশত মাইনে পাচ্ছি, কত অতিরিক্ত খরচ করছি তা দিয়ে সাফল্যের বিচার করা হয়। এই সব প্রাতিষ্ঠানিক বৈধতা খোঁজার জন্য আমরা এখন সবাই প্রশিক্ষিত। (আমরা যদি তথাকথিত এই ‘সাফল্যের’ তুল্যমূল্য বিচার না করে— আমাদের নিজস্ব বৈচিত্রকেই অস্বীকার করি, তবে কীভাবে অন্যের বৈচিত্রময় স্বভাবকে মেনে নিতে পারব)।

আমাদের এই শিক্ষা থেকে মুক্ত করুন— যাতে আমরা নিজেরাই আমাদের মূলভূত বা বুনিয়াদি সামগ্রী নিজেরাই উৎপাদন করতে পারি। বেশিরভাগ পড়ুয়ার কোনো ধারণা নেই, কীভাবে তাদের নিজস্ব খাদ্য উৎপাদন করা যায়। বন বৃদ্ধি করা যায়। তাদের নিজস্ব পোশাক তৈরি করা যায়। নিজের ঘর তৈরি করা যায়। যৌথভাবে সুস্থ সম্প্রদায় হিসেবে নিজেদের গড়েপিটে নেওয়া যায়। (নিজের হাতে কাজ করাকে এখন প্রকৃত আধ্যাত্মিক উপলব্ধির উপায় হিসেবে না দেখে সময়ের অপচয় হিসেবে দেখা হয়)। কিন্তু বর্তমান শিক্ষা— টাকাপয়সা, শিল্প-সামরিক অর্থনীতি, বৃহৎ কর্পোরেশন, প্রযুক্তিসমৃদ্ধ কাল্পনিক ব্যবস্থা, এবং সরকারি দলিল-দস্তাবেজ দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। বেশিরভাগ 'দক্ষ-প্রশিক্ষণ প্রকল্পে' আজ যে জ্ঞান এবং দক্ষতা শেখানো হচ্ছে তা, স্থানীয়করণকে শক্তিশালী করার জন্য নয়।

আমাদের আত্মস্বর, বিবেক, অন্তর্দৃষ্টি, প্রজ্ঞা, শেখার প্রক্রিয়া এবং স্থানীয় ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সন্দেহ তৈরি করে দিয়েছে এই ব্যবস্থা। আমাদের শেখানো হয় যে, সমস্ত অর্থপূর্ণ জ্ঞান এবং শিক্ষা শুধুমাত্র স্কুলেই ঘটে। এই ব্যবস্থায় বহিরাগত কর্তৃপক্ষ আমাদের দায়িত্ব নিচ্ছে, আমাদের হয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। কিন্তু তাদের স্থানীয় পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই। স্থানীয় কোনো কিছুই তারা জানে না।

স্থানিক শক্তি, আমাদের পাহাড়, বন, নদী, মাটি, বন্যপ্রাণী, পূর্বপুরুষ এবং আমাদের বন্য-আত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে এই ব্যবস্থা। আমাদের বিশ্বাস করতে শেখানো হচ্ছে যে, আমরা প্রকৃতির বাকি অংশ থেকে আলাদা। উন্নত। আমরা বুঝতেই পারি না যে, আমরা প্রকৃতির সাথে যে আচারণ করি, তা আসলে আমরা নিজেদের উপরই করি। এই ব্যবস্থা— প্রগতি, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং উন্নয়নের নামে আমাদের স্থানীয় ইকোসিস্টেম বা বাস্তুব্যবস্থাকে শোষণ, পণ্যায়নের মাধ্যমে ধ্বংস করার কাজ সহজ করে তোলে।

এই অ্যাজেন্ডা দুর্ঘটনাক্রমে চলে এসেছে এমন নয়। চলতি ব্যবস্থা এভাবেই সাজানো বা ডিজাইন করা হয়েছে। তাই এই শিক্ষা— আমাদের নিজেদের জন্যই ভুলে যেতে হবে। মানবতার এই বিপর্যয় আমরা কীভাবে ঠেকাব তা খুঁজে বার করতে হবে। সময় এসেছে, শিক্ষাবিদদের বাস্তবতা যাচাই করার। আর তাই শিক্ষার পুনর্গঠন এবং মানবতার খোঁজে যোগ দেওয়ার জন্য আসুন। আপনাদের আমন্ত্রণ রইল।

মনীশ জৈন, শিক্ষান্তর আন্দোলন এবং স্বরাজ ইউনিভার্সিটি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র, মরগান স্ট্যানলি ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক, ইউনেস্কো, ইউনিসেফ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এনজিও-তে কাজ করেছেন। তিনি একজন শিক্ষাবিদ, উদ্ভাবক, লেখক, বক্তা, চলচ্চিত্র নির্মাতা, এবং প্রশিক্ষক । ভাবানুবাদঃ সুব্রত কুণ্ডু

অক্টোবর-নভেম্বর - ২৪, ৩০-২৪, শিক্ষা, মানবতা

Comments

Popular posts from this blog

বিষমুক্ত চাষে ফেরা

রক্তচাপ কমায় টম্যাটো

আচ্ছে দিন