বিষমুক্ত চাষে ফেরা
গত পঞ্চাশ বছর বা তার কম সময়ে, প্রকৃতিকে আমরা ‘উন্নত’ কৃষির নামে বিষে জর্জরিত করে ফেলেছি। আমরা মনে করছি মানুষই ভগবান- লিখছেন সুব্রত কুণ্ডু
এই বিষাক্ত সমস্যা সমাধানের জন্য, বিষহীন চাষ পদ্ধতির মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া শুরু হয়েছে। এরসঙ্গে রাষ্ট্রসংঘ, সুস্থায়ী উন্নয়ন লক্ষ্যের ক্ষুধা মুক্তি বা 'জিরো হাঙ্গার' এর লক্ষ্যকে পরিবেশ বান্ধব চাষের সাথে যুক্ত করেছে। তাদের মত, এই চাষ টেকসই, পুষ্টি সহায়ক এবং সমৃদ্ধ জীবনযাপনের দিকে মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এটা বলে রাষ্ট্রসংঘ স্বীকার করে নিয়েছে যে, আমরা যে চাষ এখন করছি তা টেকসই নয়। পুষ্টি সহায়ক নয়।সমৃদ্ধ জীবন যাপনের অনুসারী নয়। নির্দিষ্ট কিছু তথ্যের ওপর দাঁড়িয়েই তারা এই কথা বলছে— সেটা সুস্থায়ী উন্নয়ন লক্ষ্যের বিভিন্ন তথ্য সামগ্রী দেখলে এটা বোঝা যায়।
ভারতে, প্রায় ৫৮ শতাংশ মানুষ জীবিকা নির্বাহের জন্য চাষের উপর নির্ভরশীল। নানান সররকারি, বেসরকারি, ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় বর্তমানে বিষহীন খাদ্য এবং পণ্যের উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। ভারতে এই পণ্যের বাজার ২০১৫ সালে ছিল ৩৭৫ কোটি টাকার। ২০২০ সালে যা বেড়ে হয় প্রায় ১১০০ কোটি টাকা। আশা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে এর বাজার পৌঁছবে ৩০০০ কোটি টাকায়। এটা সরকারের দাবি। টাকায় বেশি অংক দেখালেও, যদি মুদ্রাস্ফিতির হার ধরা হয়, তবে ২০১৫ পর থেকে বাজার খুব একটা বাড়েনি। এর একটি বড় কারণ, হল চাষিদের বিষমুক্ত চাষ পদ্ধতি গ্রহণ করতে সঙ্গত দ্বিধা।
সরকারি হিসেবে ২০২৪ সালের মার্চ মাস অবধি, ৭০ লক্ষ ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে ‘জৈব’ চাষ হয়। এই হিসেবে অনেকেই ভাবছেন, বাহ, বেশ অনেকটা জমিতেই তো জৈব চাষ হচ্ছে! কিন্তু আসল হিসেব হল, এর মধ্যে বড় জঙ্গল এলাকা ধরা আছে, যেখান থেকে অনেক পণ্য সংগ্রহ হয়। এরসঙ্গে রয়েছে এমন এলাকা যেখানে জলের সংস্থান খুব কম, আর পাহাড়ী অঞ্চল। অনির্বাযভাবে সেখানে বিষমুক্ত চাষ হয়। চা, কফি ইত্যাদি বাগান যেখানে রয়েছে, ব্যবসার স্বার্থে সেখানকার কিছু জমিতে বিষমুক্ত চাষ হচ্ছে। সেসব জমিও এই হিসেবে ধরা আছে। এসব বাদ দিয়ে কিছু এলাকায় ফের বিষমুক্ত চাষ শুরু হয়েছে। ভারতে ১৫ কোটি ৪৪ লক্ষ ৫০ হাজার হেক্টর জমি চাষযোগ্য। তার মধ্যে ৭০ লক্ষ ৩০ হাজার হেক্টর জমি, মানে উপরে উল্লেখ করা জমিগুলি ধরেও, মাত্র সাড়ে চার শতাংশ জমিতে ‘জৈব চাষ’ হচ্ছে।
পণ্ডিত মানুষদের বক্তব্য, বিষমুক্ত চাষের প্রযুক্তি চাষিরা জানে না। আর এত গোবর কোথায়, যে জৈব চাষ হবে। এগুলি অর্ধ সত্য। চাষিরা বিষমুক্ত চাষের প্রযুক্তি খুবই জানে। কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহারও করে। কিন্তু এর কার্য-কারণ সম্পর্ক (বা বিজ্ঞান) এবং পরিবেশ প্রকৃতিতে এর সুদূর প্রসারী প্রভাব, আর সম্পদের ব্যবস্থাপনা নিয়ে তাদের চর্চা কম। এগুলি তাদের জানানো দরকার। কারণ এখান থেকেই ফলন এবং লাভ নিয়ে সংশয় তৈরি হয়। এছাড়া বিষমুক্ত চাষের সামগ্রী, যা তাদের হাতের মুঠোয় রয়েছে, সে সম্পর্কেও জানানো দরকার। দুঃখের বিষয় হলেও সত্যি, সরকার বা অসরকারি তরফে ‘জৈব’ উৎপাদনের জন্য সাধারণত বাজারের ওপর নির্ভর করেই করতে বলা হয়। এটা ‘জৈব চাষ’ হলেও সুস্থায়ী চাষ নয়।
চাষ নিয়ে কাজ করতে হলে তো শুধু উৎপাদন নিয়ে ভাবলেই হয় না। এর সঙ্গে তার মাঠ পর্যায়ে গবেষণা, স্থানীয় সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহন, বাজার, বিশেষ করে স্থানীয় বাজার, সবটাই নিয়ে ভাবতে হয়। কিন্তু সরকার এবং এনজিও, যারা এই চাষের প্রসারক, তারা খানিকটা দায়সারাভাবেই কাজগুলি করে। বিষমুক্ত চাষের জন্য সরকারের গালভরা নামের অনেক প্রকল্প রয়েছে। যেমন জিরো বাজেট ন্যাচরাল ফার্মিং, পরম্পরাগত কৃষি বিকাশ যোজনা, মিশন অর্গানিক ভ্যালু চেইন ডেভেলপমেন্ট ফর দ্য নর্থ ইস্টার্ন রিজিয়ন, ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট সাবসিডি স্কিম, ভারতীয় প্রকৃতিক কৃষি উন্নয়ন, পার্টিসিপেটরি গ্যারান্টি সিস্টেম, ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অন অর্গানিক প্রোডাকশন, পিএম প্রণাম ইত্যাদি ইত্যাদি। এসবের বেশিরভাগটাই রফতানিকে কেন্দ্র করে তৈরি। রফতানি বলতে এখানে অন্যদেশে এবং গ্রাম থাকে বড় বড় শহরে রফতানির কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু স্থানীয় বাজারে বিক্রির গ্যারান্টির কথা এইসব উদ্যোগে নেই। এই গ্যারান্টি তৈরি করা খুবই জরুরি। এটা করতে পারলে, চাষি আরো বেশি বিষমুক্ত চাষে উৎসাহী হবে। তখন উদ্বৃত্ত পণ্য শহরে এবং বিদেশে রফতানি ভাবা যেতে পারে। মোদ্দা কথা হল ‘গাছে না উঠতেই এক কাঁদি’ ভাবলে শ্যাম বা কূল কোনোটাই থাকবে না।
অগস্ট - ২৪, ৩০ - ০৬, বিষমুক্ত চাষ
অগস্ট - ২৪, ৩০ - ০৬, বিষমুক্ত চাষ
Comments
Post a Comment