বক্সীগঞ্জের পদ্মাপারে…

বাজারের বিশ্বায়ন তো অনেক হল, এবার একটু স্থানীয়'র দিকে ফেরা যাক লিখছেন সুব্রত কুণ্ডু 


    উত্তরবঙ্গের এক বন্ধুর ফোন। তাদের পত্রিকার কৃষি সংখ্যা বেরোবে। লেখা চাই। বিষমুক্ত চাষ, তার ব্যবসা, সর্বোপরি চাষিদের লাভালাভের প্রশ্নে। এসব নিয়ে লেখা হতেই পারে। অন্য কিছুও হতে পারে। কোনো চাপ নেই। নিজের মতোই লিখুন। যতটা পারবেন লিখুন। সময় নিয়ে লিখুন— বন্ধুটি বললেন। এসব শুনলে আমার মত লিখিয়েদের সুখের অন্ত থাকে না। হ্যাঁ বলে দিলাম।

    এবার হল আসল সমস্যা। লিখব তো বললাম, কিন্তু কী লিখব? কিছু কাগজপত্র পড়ে দেখলাম, রাসায়নিক চাষের বিকল্প হিসেবে, এ রাজ্যে ফের বিষমুক্ত চাষ শুরু হয় গত শতকের নয়ের দশকে শুরুর সময় থেকে। প্রথম পনের বিশ বছর কেটেছে তো বিষমুক্ত চাষবাসের পরীক্ষা নিরিক্ষা আর তার প্রচার, প্রসার নিয়ে। সে সময় ব্যবসা যে হয়নি তা নয়। তবে তা ততটা গুছিয়ে করা যায়নি। বিক্রির জায়গা পেলে চাষিরা বিষমুক্ত চাষও করছেন।

    গত দশ বছরে এসবের ব্যবসা তার আগোছাল ভাবটা খানিকটা কাটিয়ে উঠেছে। কিছু পরীক্ষা নিরিক্ষাও চলছে। ছোট পরিসরে এই ব্যবসায় সাফল্যও এসেছে। অনেক নতুন মানুষ যুক্ত হচ্ছেন। অনেক ভেবেচিন্তে কিছু মানুষ বিষমুক্ত সামগ্রী গুছিয়ে গাছিয়ে ‘বাজারে’ আনছেন। ক্রেতারা সেখান থেকে কিনছেন। এ সবই খুবই গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। কোনটাই ফ্যালনা নয়। ঠাকুরের কথায়, যেখানেই যে-তপস্বী করেছে দুষ্কর যজ্ঞযাগ,/ আমি তার লভিয়াছি ভাগ। সেরকম কিছু না করলেও, আমিও এইসবের ভাগীদার।

    বিষমুক্ত ফসলের ব্যবসার মোটামুটি তিনটি মডেল এখনো দেখা যাচ্ছে। চাষিদের নিজেদের বাজার। তারাই উৎপাদন করছেন। বিক্রি করছেন। কিছু উৎসাহী মানুষ, চাষি ছিলেন না। এখন চাষ করছেন। উৎপাদন করছেন, প্রক্রিয়া করে, প্যাকেট ভরে বিক্রি করছেন। আর অন্যটি হল, কিছু মানুষ বিভিন্ন জায়গা থেকে সামগ্রী জোগাড় করে, মূলত শহরে বিক্রি করছেন। এই তিনটি মডেলেই একে অন্যের মিশেল রয়েছে। এরসঙ্গে রয়েছে বেশ কিছু ভালো মানুষ, যারা নানাভাবে ক্ষেত্র প্রস্তুত করার কাজ করছেন।

    এসবের ভাগীদার হয়েও আমার নিজের কাছেই প্রশ্ন, এই যে ব্যবসা হচ্ছে তা ন্যায়সঙ্গত বা ফেয়ার ট্রেড হচ্ছে তো? মানে চাষি, ক্রেতা, ব্যবসায়ী এবং প্রকৃতি উভয়ই লাভবান হচ্ছে তো? সব কিছু কেন বড় বড় শহরে এনে ফেলতে হচ্ছে? ক্ষণভঙ্গুর বিশ্বায়নের অর্থনীতিতে ঢুকে পড়া কী ঠিক হচ্ছে? স্থানীয় এবং বিকল্প আর্থিক ব্যবস্থার উদাহরণ কি কিছু আছে? আর্থিক এবং সামাজিক দিক থেকে ন্যায়সঙ্গত, প্রকৃতিমুখী, সহভাগী কোনো স্থানীয় উদাহরণ? এইসব প্রশ্ন।

    হাবিজাবি ভাবনার মাঝেই এল একটি অন্য প্রেক্ষিতে অর্থনীতিক শুভেন্দু দাশগুপ্তর নেতৃত্বে হওয়া হকারদের নিয়ে সমীক্ষার প্রসঙ্গ। তিনি ২০১৩’র ২১ অক্টোবর এই সময় পত্রিকায় লিখেছিলেন, ‘শুধু কলকাতাতেই ফুটপাথে জিনিসপত্র সাজিয়ে বসেন, এমন হকারের সংখ্যা আমি যখন সমীক্ষা করেছিলাম, তখনই দু’লাখের কাছাকাছি৷ হকারদের পুঁজি অল্প, জায়গা অল্প, মজুদ করার ক্ষমতা অল্প, আয় অল্প এবং টিকে থাকা৷ হকারদের যারা পণ্য দেন, সরবরাহকার, উৎপাদক, তাদের পুঁজি অল্প, পণ্য অল্প, প্রযুক্তি সাধারণ, উত্‍পাদন কম, আয় কম৷ যারা হকারদের কাছ থেকে কেনেন, যাদেরকে হকাররা বেচেন, তাদের আয় অল্প, কেনার ক্ষমতা অল্প, কেনার পরিমাণ অল্প৷

    এই যে তিনটি পক্ষ, ছোটো উত্‍পাদক/সরবরাহকার, ছোটো বিক্রেতা, ছোটো ক্রেতা, এরা পরস্পরের নির্ভরতায় বেঁচে আছেন৷ ছোটো বিক্রেতা, হকার, না থাকলে ছোটো ক্রেতা থাকবেন না, তেমনই ছোটো ক্রেতা না থাকলে হকাররা থাকবেন না৷ আবার তেমনই ছোটো উত্‍পাদক/ সরবরাহকার না থাকলে ছোটো হকার থাকবেন না৷ আমরা এই হাতধরাধরির নাম দিয়েছি ‘গরিব অর্থনীতি’, ‘হকার অর্থনীতি’। …গরিব বিক্রেতা হকাররা গরিব ক্রেতার জন্য ফুটপাথে ‘অন্য’ বাজার বানিয়েছেন৷ এবং বড় বাজারের দাপটের মুখে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছেন৷ এবং দাঁড়িয়ে থাকবেন’৷

    এরকম কোনো অর্থনীতির মডেল কী গ্রামবাংলায় ছিল? এখনও আছে? এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙালীর ইতিহাস বইয়ের আদি পর্বের কথা। যেখানে তিনি লিখেছেন, সাত ও আটের শতকের বিভিন্ন লিপিতে উল্লেখ করা হাটের কথা। হাটকে কেন্দ্র করে সে সময়কার ব্যবসা বাণিজ্যের কথা। তবে এত পুরনো একটা গ্রামীণ অর্থনীতির মডেল থাকা সত্ত্বেও তা নিয়ে খুব বিশদে, এযাবৎ কোনো সমীক্ষা আমার অন্তত নজরে আসেনি। তবে হাটকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্য, গল্প, নাটক, বাগধারা, বচন, প্রমাণ করে গ্রামীণ জীবনে এর প্রভাবের কথা।

    কেমব্রিজ ইকোনোমিক হিস্ট্রি অব ইণ্ডিয়ার দ্বিতীয় খণ্ডে লেখা হয়েছে— দিনাজপুরের উদাহরণ ধরেই বলা যায়, সে সময়ে জমিদারেররা কোনরকম ভাড়া বা খাজনা ছাড়াই হাটের জমি দিত এবং তার পরিকাঠামো তৈরি করে দিত। উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় কৃষি এবং কুটির শিল্পকে আরো বেশি উৎপাদন করতে উসকে দেওয়া।

    কৃষি ও কুটির শিল্পের উপর নির্ভরশীল স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম জীবনে হাট তৈরির ফলে চাষি এবং কারিগরেরা তাদের পণ্য বিক্রির জায়গা পেত। ফলে উৎপাদন বাড়াতে উৎসাহী হত। এভাবে এলাকায় ব্যবসা বাড়ার ফলে, পরোক্ষে জমিদারেরও নাম এবং উপার্জন বাড়ত। ম্যানেজমেন্টের ভাষায় যাকে বলে উইন উইন সিচুয়েশন। সবাই লাভবান হত। অবিভক্ত পশ্চিম দিনাজপুরে ছিল ১৭৪টি হাট। এর মধ্যে রায়গঞ্জের বিন্দোল হাট এবং কালিয়াগঞ্জের ধনকৈল হাট ১৮৮০ সালে হরিশ্চন্দ্রপুরের জমিদার নগেন্দ্রবিহারী চৌধুরী এবং রাসবিহারী চৌধুরী স্থাপন করেন। কাগজের হিসেবে এই দুটিই জেলার সবথেকে পুরনো হাট।

    গ্রামীণ হাটের আর্থিক কর্মকাণ্ড এতটাই বিস্তৃত ছিল যে, তা বৃটিশরাজের কোষাগারও পুষ্ট করত। ডি এইচ ই স্যান্ডার্স প্রণীত সার্ভে অ্যান্ড সেটেলমেন্টস অব দ্য ওয়েস্টার্ন ডুয়ার্স ইন দ্য ডিস্ট্রিক্ট অব জলপাইগুড়ি – ১৮৮৯-১৮৯৫ সমীক্ষা গ্রন্থে লেখা হয়েছে, পশ্চিম ডুয়ার্স (বা ধুপগুড়ি, ময়নাগুড়ি, মালবাজার, মেটেলি, নাগরাকাটা)-এ সে সময়ে ৯১টি হাট ছিল। তিনি লিখলেন, হাটগুলির পয়ঃ এবং আবর্জনার ব্যবস্থা প্রায় নেই। ফলে হাটুরেদের হাল বেশ খারাপ হয়। এটা পশ্চিম ডুয়ার্সের ডেপুটি কমিশনারের দেখা উচিত। হাটের পরিচ্ছন্নতা আর তার উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন কর বসানো উচিত। এতে ডেপুটি কমিশনার হাতে চাঁদ পেলেন। বসিয়ে দিলেন নানা ট্যাক্স। হাটের ব্যবস্থা ভালো হল না। রাজকোষে অতিরিক্ত আয় জমা পড়ল।

    হাট নিয়ে কথা বলতে গেলে গঞ্জকে বাদ দেওয়া যায় না। অভিধান বলছে গঞ্জ শব্দের সাধারণ অর্থ বাজার বা জনপদ যেখানে বিভিন্ন পণ্যের আড়ত বা গুদাম থাকে। অর্থাৎ পাইকারি বাজার। গঞ্জের সঙ্গে হাটের এক নিবিড় আর্থিক সম্পর্ক ছিল। যেখানে ৮-১০টি হাটের মূলত অপচনশীল সামগ্রী একত্রিত করা হত— বাইরের বাজারে বিক্রির জন্য। এছাড়া পশু পাখি, মনোহারি সামগ্রী বেচাকেনা হত। স্থানীয় মানুষদের প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী বিক্রি হত। আর বাইরের বিভিন্ন সামগ্রী— যা এলাকায় উৎপাদন হয় না— সেগুলিও পাওয়া যেত গঞ্জে। এগুলিকে বলা যায় হাটের ওপরে একটা ক্লাস্টার (বা বড় বাজার)।

    ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলন। সেই সময়ে রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর বঙ্গ পরিচয় বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডে লিখেছেন ‘…দেশের মধ্যে যেসব সামগ্রী বা শস্য বা কাঁচামাল প্রস্তুত হয়, তাহা দেশের মধ্যেই ক্রয়-বিক্রয় হয়। এইসব মাল মানুষের মাথায়, গরুর গাড়ীতে নৌকায়, রেলে, স্টিমারে, মোটর লরীতে একস্থান হইতে অন্যস্থানে স্থানান্তরিত হয়। পাঁচ কোটি লোকের নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য-সামগ্রী, গো-মহিষের খাদ্যশস্য, খৈল, ভূষি প্রভৃতি, দেশের মধ্যে প্রস্তুত কাপড়-চোপড়, তাছাড়া বিদেশ হইতে আমদানী মাল হাটে, বাজারে, দোকানে বিক্রয় হয়, ফেরিওয়ালারা ফিরি করিয়া বিক্রয় করে। এইভাবে প্রকাণ্ড আন্তর-বাণিজ্য দেশের মধ্যে চলিতেছে। ইহার মূল্য যে কত তাহা অনুমান করা দুঃসাধ্য…’।

    হাট শুধু ব্যবসার জায়গা ছিল না গ্রামীণ জীবনে। ১৯৯৬ সালে অদিতি চ্যাটার্জী তার হাটস অ্যান্ড মেলাস বইয়ে লিখেছেন, ‘একটি হাট গড়ে আশেপাশের ১৬টি গ্রামের চাহিদা পূরণ করে। প্রতিটি হাটে গড়ে দোকানের সংখ্যা ৩১৪টি। আর গড়ে ১১০০ জন মানুষ হাটে আসে। হাটে স্থানীয় পণ্য বিক্রি হয়, বিনিময়ও হয়। দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের পাশাপাশি চাষবাসের সরঞ্জাম কেনাবেচার ব্যবস্থা থাকে। এছাড়াও সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক যোগাযোগের একটি জায়গা হল হাট’।

    বিশ্ব ব্যাঙ্ক তার ২০০৮ সালে ইণ্ডিয়া কান্ট্রি ওভারভিউতে বলেছে— হাটের কোনো পরিকাঠামো নেই। তথ্য, বিনিয়োগ এবং ঋণহীন, পরিবহন ব্যবস্থাহীন অত্যন্ত খণ্ডিত প্রকৃতি নির্ভর গ্রামীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। যেখানে এখনো বিনিময় ব্যবস্থা চলে। হাট নিয়ে সরকারের কোনো হেলদোল নেই। নেই কোনো নির্দিষ্ট সরকারি নিয়মনীতি। হাট চলে স্থানীয় সামাজিক ব্যবস্থা এবং যোগাযোগের উপর ভিত্তি করে। এটা তাদের পক্ষে বলা স্বাভাবিক। কিন্তু এত খারাপ ব্যবস্থা হওয়া সত্ত্বেও আবহমানকাল ধরে হাট কীভাবে টিকে রয়েছে, তা এক গবেষণার বিষয় বৈকি! তবে বিশ্বায়ন ও তার মুক্তবাজারে, গ্রামীণ সংস্কৃতির অন্যতম ধারক-বাহক হাটসহ অন্য কোনো কিছুরই কোনো গুরুত্ব নেই।

    হাটের সঙ্গে গ্রামীণ জনপদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, আচার কিংবা সভ্যতার বিকাশে যে এক বিরাট যোগাযোগ তা আরেকটু অন্দরে গিয়ে দেখলে, তার বিস্তৃত পরিসর খুঁজে পাওয়া যায়। নগর সভ্যতার বাড়-বাড়ন্তে এখন পাড়ায় পাড়ায় প্রতিদিন বাজার বসছে। সে বাজার প্রতিযোগিতার। কেনাবেচা, মুনাফা আর প্রতিযোগিতা এই বাজারে মুখ্য। কিন্তু হাট মানে সাপ্তাহিক এবং পণ্য বেচাকেনার প্রতিযোগিতা ছাপিয়েও যেন উৎসব। সেখানেও বাণিজ্য ছিল। তবে তা হয়ে উঠত স্থানীয়দের মিলনমেলা।

    বিশ্বব্যাঙ্কের কথার মধ্যে একটি সত্যতা আছে। হাট নিয়ে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। ২০২২ এর ১৫ জুলাই করোনার ফলে নুয়ে পড়া গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে রাজ্যের ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং কুটির শিল্প দফতর জেলাশাসকদের চিঠি দিয়ে জেলার হাট বাজারের পরিকাঠামো নিয়ে জানতে চেয়েছিল। চিঠিতে লেখা হয়েছিল, যে সব গ্রামীণ হাট–বাজারের পরিকাঠামোগত উন্নয়নের প্রয়োজন রয়েছে তার তালিকা পাঠাতে হবে। সেখানে উল্লেখ করতে হবে এলাকার নাম, রেল স্টেশন এবং জাতীয় বা রাজ্য সড়ক বা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ বড় রাস্তার নাম। আর তা থেকে বাজার বা হাটের দূরত্ব। কত দোকান রয়েছে, কত মানুষ পেশাগতভাবে যুক্ত। আর কী কী ধরনের সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে ইত্যাদি। কিন্তু এর ফলাফল কী হল তা কেউ জানে না।

    আগেই উল্লেখ করেছি শুভেন্দু দাশগুপ্ত লিখেছিলেন, ‘…গরিব বিক্রেতা হকাররা গরিব ক্রেতার জন্য ফুটপাথে ‘অন্য’বাজার বানিয়েছেন৷ এবং বড় বাজারের দাপটের মুখে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছেন৷ এবং দাঁড়িয়ে থাকবেন’৷ গ্রামীণ হাটও এক কথায় তাই। এটা স্বল্প পুঁজির বিক্রেতারা ও ক্রেতার জন্য ‘অন্য’ বাজার। যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।

    হাট বসেছে পাকুড়তলায় ইছেমতির ধারে/পাকুড়তলায় হাট বসে ভাই শনি-মঙ্গলবারে/নদী বেয়ে নৌকা এল ধানের পালি নিয়ে,/সওদা নিয়ে মানুষ এল মেঠো পথ দিয়ে,/ পাটালি গুড় বেচে বসে নয়নপুরের গাছি/নতুন গুড়ের গন্ধ পেয়ে ছুটল সোনামাছি।/ অছিমুদ্দির টিনের চালা, লোকের ভিড়ে ঠাসা,/আছিমুদ্দি তাঁতি ভালো, কাপড় বোনে খাসা।/হট্টগোলের মাঝে শুনি অন্ধ বাউল গায়।/‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়’।

    ভাষাবিদ জ্যোতিভূষণ চাকী লিখছেন ‘একদিন এইভাবেই হাটের ছবি এঁকেছিলাম শৈশব স্মৃতি থেকে’। তিনি তাঁর দাদুর সঙ্গে যেতেন দিনাজপুরের হাটে। তিনি লিখেছেন ‘আমার শৈশবে হাট ছিল আশ্চর্য এক জগৎ’। এরকম অনেকেই হাট তার অর্থনীতি, তার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসর নিয়ে অনেক কথাই লিখেছেন।

    ছোটবেলায় পড়া ঠাকুরের ‘হাট’ কবিতা মনে করুন। ভেবে দেখুন কী আসছে হাটে। কীভাবে আসছে। কারা উৎপাদক, কারা কারিগর। কীভাবে উৎপাদন হচ্ছে। কারা ক্রেতা বা বিক্রেতা। বেচাকেনা ছাড়া আর কী হচ্ছে। এরকমই একটি পরিসর তো আমরা চাই। যেখানে ফুড মাইলের সমস্যা নেই। নেই কার্বন ফ্রুট প্রিন্ট, গ্লোবাল ফুট প্রিন্টের সমস্যা। গ্রিন হাউস গ্যাস নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে না। ভাবতে হচ্ছে না প্লাস্টিক জঞ্জাল নিয়ে।

    যেখানে স্থানীয় মানুষ তাদের সহভাগী গণতান্ত্রিক চেতনার মাধ্যমে হাটের পরিচালনা করছে। নিজেরাই তাদের উৎপাদনের দাম ঠিক করছে। পরিবহন ঠিক করছে। বিনোদনের মাধ্যম ঠিক করছে। যারা বিষমুক্ত খাবার-দাবার, সামগ্রী অনেক পরিশ্রম করে, সবার ভালোর জন্য বেশিরভাগ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছেন— তারা এমন ব্যবস্থার জন্যই তো লড়ে যাচ্ছেন।

    ২০০ বছরের শিল্পায়ন এবং তার হাতে হাত ধরে এগিয়ে চলা বেচে খাওয়ার অর্থনীতি আমাদের উপহার দিয়েছে, দিয়ে চলেছে, জলবায়ু বদল, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, অতিমারি। এখন তাপমাত্রা বৃদ্ধি, মানব জাতির অবলুপ্তির কথা শুনলেও বেশিরভাগ মানুষ মনে করছেন, বিজ্ঞানীরা নিশ্চয়ই একটা সমাধান বের করে দেবেন। কিন্তু আইপিসিসিতে ৭৮২ জন বিজ্ঞানী এবং একশোর ওপর বিশেষজ্ঞ মিলে জলবায়ু বদল নিয়ে ষষ্ঠ অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট তৈরি করছেন— তাতে কিন্তু কোনো আশার বাণী শোনা যাচ্ছে না। তাঁরা দেখিয়েছেন, ক্রমশ দ্রুততর হচ্ছে জলবায়ু বদল। যার ফলে বিপর্যয়ের ঘটনা বেড়ে চলেছে। মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলে বিশ্ব উষ্ণায়ন যত বাড়বে, তত বৃদ্ধি পাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। গলে যাবে মেরু অঞ্চলে বরফের আবরণ। আর বেড়ে চলবে তাপপ্রবাহ, খরা, বন্যা ও ঝড়ের মতো আবহাওয়ার চরম বিপর্যয়। বিজ্ঞানীরা ঠারেঠোরে বুঝিয়েছেন, বেচে খাওয়ার অর্থনীতি এবং মানুষের লোভ, প্রকৃতি বা বেঁচে থাকার আধারকেই শেষ করে দিচ্ছে।

    আশার কথা, বিশ্বায়িত বেচে খাওয়ার অর্থনীতির বিকল্প হিসেবে দেশে দেশে, স্থানীয়ভাবে, বেঁচে থাকার ও বাঁচিয়ে রাখার অর্থনীতি নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরিক্ষা, আন্দোলন শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে গ্লোবালাইজেশনের বদলে লোকালাইজেশনের আন্দোলন। আমাদের এখানে ছোট পরিসরে যারা বিষমুক্ত চাষবাস, উৎপাদন ও ব্যবসা করছেন। যারা সেই সামগ্রী কেনাকাটি করছেন। তারা অনেকেই আসলে লোকালাইজেশন বা স্থানীয়করণের আন্দোলনে যুক্ত। আর আমার মতে, গ্রামীণ হাট স্থানীয় অর্থনীতির একটি উৎকৃষ্ট মডেল ছিল। ফের হতেই পারে।

    অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, হাটের যে ছবি এতক্ষণ ধরে আঁকা হল, সেটা তো এক কষ্ট কল্পনার নামান্তর? আমরা কী আবার সেই গরুর গাড়ির যুগে ফেরত যাব? হাট কী আর আগের মত আছে? গ্রামীণ অর্থনীতিতে তার কী কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে?

    না, এখন প্রায় নেই বললেই চলে। চাষও তো বিষমুক্ত ছিল না। সেটা জেনেই তো আমরা এগিয়েছি। গত ৩০-৩৫ বছরে তো বিষমুক্ত চাষও তাই অনেকটাই এগিয়েছে। আমাদের সদিচ্ছা, উদ্যোগ, সাফল্য দেখে আরো অনেক মানুষ জুড়েছেন এই কাজে। সরকারও নানাভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু আরো অনেক পথই হয়তো হাঁটতে হবে। বিশেষ করে ব্যবসার জন্য। ন্যায়সঙ্গত বিকিকিনি জন্য। হাট সেরকমই এক পারম্পরিক আর্থিক ক্ষেত্র ছিল। ছিল গ্রামীণ মানুষের যৌথ উদযোগে তৈরি এবং নিয়ন্ত্রিত ক্ষেত্র। ছিল বিশ্বায়িত লোভ ও ভোগের বিপরীতে পরিমিতিবোধের অর্থনৈতিক ক্ষেত্র। যেখানে ক্রেতা, উৎপাদক, সরবরাহকার, বিক্রেতা সবাই ছিল স্বল্পবিত্তের।

    ছিল বলছি কেন! গ্রামবাংলার কোথাও কোথাও, বিশেষ করে আদিবাসী অঞ্চলে এখনও এমন ক্ষেত্র আছে। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এখনও এদেশের বেশিরভাগ মানুষই স্বল্পবিত্ত এবং গ্রামেই থাকে। এরকম ভাবনা নিয়ে আশ্রমিক শ্যামলী খাস্তগীর এবং তাঁর সহযোগীদের উদ্যোগে শান্তিনিকেতনের খোয়াইয়ে হাট শুরু হয়েছিল। সে হাট এখন কলেবরে অনেক বেড়েছে। নানা কারণে, উদ্দেশ্য অনেকটাই লঘু হয়ে গেলেও, এখনও স্থানীয় উৎপাদক তাদের সামগ্রী নিয়ে এখানে বিকিকিনির জন্য আসেন। স্থানীয় হস্তশিল্পীদের জন্য এমনই একটি হাট, সদ্য শুরু হয়েছে বীরভূমের ইলামবাজারের রামনগরে। চৌপাহাড়ি হস্তশিল্প হাট।

    এরকম উদ্যোগ আরো হয়ত আছে। কিন্তু যা আছে, যতটুকু আছে, যতটুকু গ্রামীণ অর্থনীতিতে হাটের অবদান রয়েছে তা জানা, বোঝা দরকার। তার আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক আর হ্যাঁ, রাজনৈতিক গুরুত্ব খুঁজে দেখা দরকার। কারণ প্রকৃতিমুখী উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে তার উপযুক্ত বিপণন ক্ষেত্রও জরুরি। আর হাট এই পরিসরে একটি অন্যতম বিপণন ক্ষেত্র হতে পারে।

এখানে উদ্ধৃত লেখার বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে

১৩০৬২৪

Comments

Popular posts from this blog

লিঙ্গসাম্যের দিকে এগোচ্ছে দেশ

পারম্পরিক জ্ঞানের তথ্যায়ন

দাঁতের ব্যথায় লবঙ্গ