খাদ্য স্বয়ম্ভরতা কিছু তথ্য কিছু প্রশ্ন

খাদ্য স্বয়ম্ভরতার হাল হকিকত নিয়ে লিখছেন সুব্রত কুণ্ডু 

খাদ্য স্বয়ম্ভরতার ইতিহাস
খাদ্য স্বয়ম্ভরতার ধারণাটি ১৯৯০-এর দশকে সবুজ বিপ্লব এবং বিশ্বব্যাপী মুক্ত বাণিজ্য নীতির প্রবর্তনের বিরুদ্ধে, সারা বিশ্বের গ্রামীণ সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে শুরু হয়। কৃষি শিল্পের পরিবেশগত প্রভাবের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে, ছোট চাষিদের সংগঠন এজন্য একত্রিত হয় এবং খাদ্য স্বয়ম্ভরতার আন্দোলন শুরু করে। এরপরে গত ৩০ বছরে খাদ্য স্বয়ম্ভরতার ধারণা এবং এর সাথে সম্পর্কিত সুস্থায়ী সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং প্রকৃতিগত বক্তব্যের সঙ্গে সহমত হয়ে, অনেক চাষি, জেলে, বনবাসি, খাদ্য উৎপাদনে যুক্ত শ্রমিক, ভোক্তা, শিক্ষাবিদ এবং খাদ্য ব্যবস্থা নিয়ে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থা এই আন্দোলনে একত্রিত হয়।

খাদ্য স্বয়ম্ভরতার সংজ্ঞা
খাদ্য স্বয়ম্ভরতার আন্দোলনের পরিসর বৃদ্ধির সঙ্গে এর সংজ্ঞাও ক্রমশ বিকশিত হয়েছে। সাধারণভাবে বলা যায়, খাদ্য স্বয়ম্ভরতা হল, স্থানীয়, পরিবেশমুখী এবং টেকসই পদ্ধতির মাধ্যমে উত্পাদিত স্বাস্থ্যকর এবং সাংস্কৃতিকভাবে উপযুক্ত খাদ্যের অধিকার এবং স্থানীয় মানুষজনের নিজস্ব খাদ্য ও কৃষি ব্যবস্থা রূপায়িত করার অধিকার।

খাদ্য স্বয়ম্ভরতা, বর্তমান কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থায় তৈরি ক্ষমতার বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটি আন্দোলন। এটি স্পষ্টভাবে কৃষি শিল্পের আধিপত্য, কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থায় কর্পোরেশনের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা এবং খাদ্য ও কৃষি বাণিজ্যের অগণতান্ত্রিক শাসনের প্রতিস্পর্ধী এক আন্দোলন।

খাদ্য স্বয়ম্ভরতা সাধারণত কৃষি-বাস্তুতন্ত্র (অ্যাগ্রো-ইকোলজি) নির্ভর ছোট চাষি ও পারিবারিক কৃষি এবং স্থানীয় বা আঞ্চলিক খাদ্য ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দেয়। এই ব্যবস্থায় উৎপাদক এবং ব্যবহারকারীদের মধ্যে দুরত্ব কমে। ফলে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার কমে। তবে বলে রাখা ভাল, খাদ্য স্বয়ম্ভরতার সংজ্ঞা তুলনামূলকভাবে উন্মুক্ত, কারণ এর আন্দোলন গণতান্ত্রিক এবং সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং প্রসঙ্গ-নির্দিষ্ট সমাধানকে অগ্রাধিকার দেয়।

নিরাপত্তা বনাম স্বয়ম্ভরতা
খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বা এফএও’র ব্যবহৃত খাদ্য নিরাপত্তার সংজ্ঞা, খাদ্য পাওয়ার ওপর জোর দেয়। কীভাবে তার উৎপাদন এবং বন্টন হবে তার ওপর নয়। স্বয়ম্ভরতা কিন্তু এ ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে খাদ্যকে একটি পণ্য এবং লাভের উত্স হিসাবে দেখানো হয় না। এছাড়া ক্ষুধা ও অপুষ্টিকে এই সব সংস্থা একটি প্রযুক্তিগত সমস্যা হিসেবে দেখায়। কিন্তু স্বয়ম্ভরতার আন্দোলন মনে করে, ক্ষুধা ও অপুষ্টি হল তৃণমূল স্তরের একটি রাজনৈতিক সমস্যা, যার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত বিষয়ও। আর খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নটি এখনো রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক নীতিকারদের আলোচনার হাতিয়ার।

তবে সময়ের সময়ের সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তার সংজ্ঞা কিছুটা হলেও, খাদ্য উৎপাদন, বন্টন এবং তার নিয়ন্ত্রণে, সবার অংশগ্রহণ, সাম্য ইত্যাদির গুরুত্ব স্বীকার করছে। তবে বিশ্বব্যাপী কৃষি শিল্প এবং খাদ্য চলাচলের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গী একই রয়ে গেছে।

খাদ্য স্বয়ম্ভরতা - কিছু প্রশ্ন
খাদ্য স্বয়ম্ভরতার আন্দোলনের জোর বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন মানুষ যেমন যুক্ত হয়েছে, তেমনই এর ভিতর এবং বাইরে থেকে নতুন নতুন প্রশ্ন উঠে আসছে। সেগুলির মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল- স্থানীয়ভাবে টেকসই কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থা তৈরি হলেও কীভাবে একটি খাদ্য স্বয়ম্ভর বাণিজ্য ব্যবস্থা তৈরি হবে? কোন পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক বাণিজ্য গ্রহণযোগ্য হবে, নাকি একেবারেই গ্রহণযোগ্য হবে না? খাদ্য স্বয়ম্ভর ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের কী ভূমিকা হবে ? এরজন্য কী কী নীতি-পদ্ধতি বদলাতে হবে বা নতুন নীতি-পদ্ধতি তৈরি করতে হবে? স্বায়ত্তশাসিত, স্বয়ম্ভর এবং স্থানীয় খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কোন কোন আইন, নীতি-পদ্ধতির খোল নলচে বদলাতে হবে?

কিছু সমালোচক প্রশ্ন করে, খাদ্য স্বয়ম্ভরতার মাধ্যমে, বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিভিন্ন চাহিদা মেটাতে পারে, এমন খাদ্য ব্যবস্থা তৈরি করা আদৌ কী সম্ভব? তাদের বক্তব্য, উত্পাদক এবং ভোক্তাদের প্রায়শই পরস্পরবিরোধী অর্থনৈতিক স্বার্থ থাকে এবং স্থানীয় কৃষি-বাস্তুতন্ত্র নির্ভর খাদ্য ব্যবস্থা তা পূরণ করতে পারে না। এছাড়া যে প্রশাসনিক কাঠামোর কথা খাদ্য স্বয়ম্ভরতা আন্দোলন বলে, সেটা রাষ্ট্রের কোন গণতান্ত্রিক কাঠামোতে সম্পৃক্ত করা যাবে তার কোনো দিশা নির্দেশ এখনও তৈরি নয়? তাহলে কী একটা নৈরাজ্যবাদী ব্যবস্থা তৈরি হবে এই ব্যবস্থা লাগু হলে?

খাদ্য স্বয়ম্ভরতার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কি একটি মূল ভূমিকা পালন করা উচিত? যদি তাই হয়, তাহলে বিশ্ব বাণিজ্য চুক্তির বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে?

এই প্রশ্নগুলি কিছুটা অনিবার্য, কারণ খাদ্য স্বয়ম্ভরতা আন্দোলন একাধিক ভিন্ন এলাকা ও গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত। তাদের নিজেদের মধ্যে সমন্বয় থাকলেও এক একটি এলাকায় তারা তাদের সদস্যদের নিয়ে স্বায়ত্তশাসিত ব্যবস্থা চালায়। তাই খাদ্য ভবিষ্যত নির্ধারণের অধিকার কেন্দ্রিক একটি সুনির্দিষ্ট ও সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর জোর খুব একটা থাকে না। তবে এই সব প্রশ্নের উত্তর তৈরি করতেই হবে খাদ্য স্বয়ম্ভরতা আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী করার জন্য।


ফেব্রুয়ারি - ২৪, ২৯-৫৬, খাদ্য, স্বয়ম্ভরতা 

Comments

Popular posts from this blog

লিঙ্গসাম্যের দিকে এগোচ্ছে দেশ

পারম্পরিক জ্ঞানের তথ্যায়ন

দাঁতের ব্যথায় লবঙ্গ