খাদ্য স্বয়ম্ভরতা

কীভাবে খাদ্য তৈরি হবে, তার ব্যবহার ও বন্টন হবে, কীভাবেই বা হবে খাদ্যের ন্যায়সঙ্গত ব্যবসা— এসবের নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত স্থানীয় মানুষদেরই হাতে... লিখছেন সুব্রত কুণ্ডু

দুর্গা একজন চাষি। তার দুই ছেলে ও মেয়ে। থাকে বারুইপুরের কাছে বৈকুন্ঠপুর গ্রামে। পরিবারে সে-ই একমাত্র আয় করে। তার দু বিঘা চাষের আর পুকুর নিয়ে এক বিঘা বাস্তু জমি। এই জমিতে সে সারা বছর সবজি ও ধান চাষ করে। আগে সে ও তার বর রাসায়নিক সার, বিষ দিয়েই চাষ করত। ২০২০ সালে কোভিডের সময়, দেনার দায়ে, চাষের জন্য রাখা বিষ খেয়ে তার বর আত্মহত্যা করে। এখন দুর্গা তার জমিতে রাসায়নিক সার বিষ ছাড়া, জৈব উপায়ে চাষ করে। বালিগঞ্জ রেলস্টশনের পাশে, জৈব ফসল বিক্রির একটি দোকান আছে। মহাজনের থেকে একটু বেশি দামের আশায়, সে সপ্তাহে চার দিন এই দোকানে তার উৎপাদন করা শাক সবজি দেয়। এই আয়ে তার সংসার চলে।

জৈব উপায়ে চাষের জন্য এখন তাকে জল, মাটি, বীজ ইত্যাদি সম্পদের টেকসই ব্যবহারের দিকে নজর দিতে হয়। নজর রাখতে হয় তার জমির ইকো সিস্টেম বা বাস্তু ব্যবস্থার ওপর। পাশাপাশি আয় যাতে সবথেকে বেশি হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হয়। পড়াশোনার সাথে তার ছেলে ও মেয়ে চাষের কাজে সাহায্য করে। এইভাবে তারা জৈব চাষের অনেক খুঁটিনাটি বিষয় শিখে গেছে।

অভিষেক একজন যুবক। তার বাড়ি শিলিগুড়ি শহরে। চাকরি সূত্রে সে কলকাতার একডালিয়া পার্কে থাকে। সে খুব সহজেই তার খাবার জোগাড় করতে পারে। সে যেমন স্থানীয় বাজার, জৈব ফসলের দোকান, ঝাঁ চকচকে মল থেকে খাবার কেনে। আবার তৈরি খাবার বিভিন্ন দোকান, রেস্তোরাঁ থেকে আনিয়েও নেয়। কখনো বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় গিয়ে খায়। অভিষেক এবং তার মত অনেক শহুরে মানুষ, দরকারের থেকে অনেক বেশি খাবার কেনে। তাই খাবারের অপচয়ও হয়।

তবে দুর্গা আর অভিষেক দুজনেই বিশ্বজুড়ে চলা কৃষি শিল্প এবং তার থেকে তৈরি খাদ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখে। তারা জানে এই ব্যবস্থা টেকসই নয়— মানে বেশি দিন টিকবে না। এই চাষ ও খাদ্য ব্যবস্থার ফলে জলবায়ু বদল হচ্ছে। মাটি, জল, হাওয়া, দূষিত হচ্ছে। জীববৈচিত্র কমে যাচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের গরিব ও খেটে খাওয়া  মানুষের খাবারের অভাব হচ্ছে। আর গ্রামীণ জীবনেও প্রচুর চাপ তৈরি হচ্ছে।

বহুক্ষেত্রে চাষি এবং গ্রামীণ উৎপাদকরা, তাদের উৎপাদিত সামগ্রীর দাম পাচ্ছে না। তাই অল্প বয়সীরা চাষ করতে চাইছে না। আর চাষি এবং গ্রামীণ কারিগরেরা তাদের কাজ ছেড়ে মজুরে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু খাদ্য ব্যবসায়ী বড় বড় কোম্পানিগুলির প্রচুর মুনাফা বাড়ছে। অনেক জায়গায় চাষিদের উর্বর জমি জোর করে দখল নিয়ে নেওয়া হচ্ছে কৃষিশিল্প ও খাদ্য ব্যবসার জন্য। বেঁচে থাকার তাগিদে এই শিল্প এবং ব্যবসায় যে মজুরেরা যুক্ত হচ্ছে, তাদের মানবাধিকার বলে কিছু থাকছে না। দাসে পরিণত হচ্ছে তারা।

বিশ্বের বিরাট সংখ্যক মানুষের খাবারের অভাব হলেও, বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন খাদ্য সামগ্রী বাজার ছেয়ে ফেলছে। তবে এইসব খাবারের বেশিরভাগটাই প্রক্রিয়াজাত এবং তাদের গুণমান বেশ খারাপ। ফলে খাবারের সঙ্গে যুক্ত স্বাস্থ্যের অবস্থাও সঙ্গীন হয়ে উঠছে। নতুন নতুন রোগ ব্যাধি জাঁকিয়ে বসছে। সতেজ, উপযুক্ত, মরশুমি, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যকর খাবার পাওয়া এখন বেশ দুষ্কর।

দুর্গা এবং অভিষেকের মত স্থানীয় মানুষদের জন্য কীভাবে খাদ্য তৈরি হবে, কীভাবে ব্যবসা হবে এবং কীভাবে খাদ্য বন্টন ও ব্যবহার হবে- তার ওপর স্থানীয় মানুষদেরই নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। অধিকার থাকা উচিত জমি, জল, বীজ ইত্যাদি মূলভূত সম্পদের ওপর। অধিকার থাকা উচিত এ নিয়ে স্থানীয় নীতি, নিয়ম, পরিকল্পনা, প্রকল্প তৈরির। খাদ্যের ওপর এই অধিকারই হল খাদ্য স্বয়ম্ভরতা। 

খাদ্য স্বয়ম্ভরতা মানুষ এবং পরিবেশের পক্ষে ভালো খাদ্য ব্যবস্থা তৈরিতে সহায়তা করে। কৃষি শিল্পের বদলে স্থানীয় প্রকৃতিমুখী চাষ ব্যবস্থা তৈরি, স্থানীয় এবং ন্যায় সঙ্গত ব্যবসা এবং এগুলি সম্পর্কীত নীতি-পদ্ধতি তৈরি করতে সাহায্য করে। যার থেকে মানুষ, বিষমুক্ত, স্বাস্থ্য এবং পুষ্টিকর খাবার পায়। প্রাকৃতিক দিক থেকে টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থা তৈরি হয়। এটা স্থানীয় এবং আঞ্চলিক বাজার ব্যবস্থা এবং অর্থনীতিকে পরিপুষ্ট করে। উৎপাদক এবং ভোক্তা উভয়ই লাভবান হয়। দুর্গা এবং অভিষেকের মত সব মানুষই পর্যাপ্ত খাবার পাওয়ার অধিকারী হয়। তারা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত স্বাস্থ্য এবং পুষ্টিকর, ভালো গুণমানের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং পছন্দ অনুযায়ী খাবার পায়।

ডিসেম্বর - ২৩, ২৯-৪১, খাদ্য স্বয়ম্ভরতা, কৃষি অর্থনীতি

Comments

Popular posts from this blog

রক্তচাপ কমায় টম্যাটো

সার থেকে ক্যান্সার

আচ্ছে দিন