বর্তমান কৃষি, জলবায়ু আর পারম্পরিক চাষ

পারম্পরিক ব্যবস্থায় উৎপাদন স্থানীয় নিয়ন্ত্রণে থাকে। তাই চাষ টেকসই হয়। উৎপাদন, বন্টন সবই স্থানীয়ভাবে হতে পারে

পর্যাপ্ত খাদ্য এবং পুষ্টির সুযোগ পাওয়া একটি মৌলিক মানবাধিকার। তবুও বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ পুষ্টিকর খাদ্য এবং বিশুদ্ধ জল পায় না। বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এবং ক্ষুধা ও অপুষ্টি মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য প্রতি বছর ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস পালিত হয়। লক্ষ্য হল, প্রত্যেকের নিরাপদ, পুষ্টিকর এবং পর্যাপ্ত খাবারের সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য টেকসই কৃষি এবং খাদ্য ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা কথা তুলে ধরা। তবে এই ‘দিবস’ ধুমধাম করে পালন করা হলেও, কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তাই খাবারের অভাবও পূরণ হচ্ছে না। টেকসই কৃষি তো দূর অস্ত। উদাহরণ হিসেবে ভারতের অবস্থাই ধরা যাক—

ভারত, জলবায়ু বদলের হিসেবে সপ্তম সবচেয়ে ঝুঁকি পূর্ণ দেশ। কাউন্সিল অন এনার্জি এনভায়রনমেন্ট অ্যা ন্ড ওয়াটারের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ভারতের প্রতি চারটি জেলার মধ্যে তিনটি হল চরম জলবায়ু ঘটনার হটস্পট। এই জেলাগুলিতে অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধি, খরা, বন্যা ও তাপপ্রবাহের ক্রমবর্ধমান ঘটনা এবং তার তীব্রতা দেখা যায়।

দরিদ্র ও প্রান্তিক, বিশেষ করে নারীরা জলবায়ু সংকটের অসম ভার বহন করে।ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক সাউথ এশিয়ার একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে জলবায়ু বদলের ফলে প্রভাবিত এবং উদ্বাস্তু পরিবারের মহিলাদের কমপক্ষে ১২-১৪ ঘন্টা বিভিন্ন কাজে ব্যয় করতে হয়। এই ঘটনাগুলি প্রমাণ করে, প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বরকে বাদ দিয়ে— বৈশ্বিক বা জাতীয় স্কেলেই হোক— বর্তমান সমাধানগুলি জনসংখ্যার একটি বড় অংশকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। এর ফলে পারম্পরিক জ্ঞান, উপলব্ধি, সম্পদ ব্যবহার হচ্ছে না। ফলে কৃষিসহ অন্য সব কিছুই টেকসই এবং দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না।

ভারতে গোন্ড যুগে অধিকাংশ লোকের জীবিকার ভিত্তি ছিল কৃষিকাজ এবং আনুষঙ্গিক কার্যক্রম। গোন্ড রাজাদের দ্বারা নির্মিত অধিকাংশ পুকুর ছিল খালবিহীন। এর অর্থ সেই জল সাধারণত সেচের কাজে ব্যবহার হত না। তবে মূলত আর্দ্রতা এবং ভূগর্ভস্থ জলের তল বৃদ্ধি, জলবায়ু ভারসাম্য বজায় রাখা, নির্ভরযোগ্য পানীয় জলের উৎস বজায় রাখা এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য মাছ ধরা, জলে হয় এমন ফসল চাষ হত। মধ্যপ্রদেশের নরসিংহপুর, জব্বলপুর, সাগর ও দামোহ জেলায়, গভীর কালো মাটিতে আর্দ্রতা সঞ্চয় করার এবং এর ভিত্তিতে সেচ ছাড়াই, রবিতে ভাল ফসল পাওয়ার দেশীয় পদ্ধতি প্রচলিত ছিল।

এরাজ্যের পুরুলিয়ার মত শুখা জেলার বিভিন্ন অংশে শিশিরের জল সঞ্চয় করে আখের চাষ করা হত। এরকম উদাহরণ এখনো বহু জায়গায় ছড়িয়ে আছে। প্রকৃতি এবং জলবায়ুর ভারসাম্য বজায় রাখা এই সব পারম্পরিক ব্যবস্থা ভুলে আমরা তথাকথিত উৎপাদনমুখী সবুজ বিপ্লব প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। এতে নির্দিষ্ট কিছু ফসলের উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু বিষিয়ে গেছে জল, হাওয়া, মাটি। উৎপাদন বাড়লেও তা মানুষের হাতের বাইরে চলে গেছে। সমাজবিজ্ঞানী, অর্থশাস্ত্রীরা বারবার দেখিয়েছেন, বেশি উৎপাদন হলেই সবার কাছে খাদ্য পৌঁছবে এরকম কোনো গ্যারান্টি নেই। কারণ খাদ্য উৎপাদন এবং বন্টন ব্যবস্থার সম্পুর্ণ কেন্দ্রীকরণ হয়ে গেছে। এছাড়া বেশি উৎপাদনের তাড়নায় জমি, জল, হাওয়া বিষময় হয়ে ওঠায় নির্মল খাদ্য পাওয়ার সুযোগ কমেছে। কিন্তু পারম্পরিক ব্যবস্থায় উৎপাদন স্থানীয় নিয়ন্ত্রণে থাকে। তাই চাষ টেকসই হয়। উৎপাদন, বন্টন সবই স্থানীয়ভাবে হতে পারে। পরিবেশ বিষাক্ত হয় না।

নভেম্বর - ২৩, ২৯-৩৭, সুস্থায়ী কৃষি, জলবায়ু বদল

Comments

Popular posts from this blog

রক্তচাপ কমায় টম্যাটো

সার থেকে ক্যান্সার

আচ্ছে দিন