জৈব চাষে জোর, বরাদ্দ নামমাত্র

সরকার জৈব চাষে গুরুত্ব দিচ্ছে। আশার কথা। কিন্তু অর্থ বরাদ্দ করছে কি ? লিখছেন সুব্রত কুণ্ডু


অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ২০২৩-২৪ এর বাজেটে বক্তৃতায় যা যা বলেছেন সে সব কাজে রূপান্তরিত করতে পারলে, ভারতে জৈব/প্রাকৃতিক চাষের ব্যাপক প্রসার ঘটবে। তবে এই কাজ করার জন্য চাই অর্থ। আর সেই অর্থ বরাদ্দের কথা খুব খোলসা করেননি অর্থমন্ত্রী। ফলে আশঙ্কা, এই সরকারের কৃষি নিয়ে বেশিরভাগ ঘোষণার মতো এই সব কথাও ‘জুমলা’ হয়ে যাবে না তো! চাষিরা তো ঘর পোড়া গরু তাই সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়।

২০২২-২৩ এর অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতে ৪৪ লক্ষ ৩০ হাজার জন জৈব চাষি রয়েছে। বর্তমান কেন্দ্রীয় বাজেট বলা হয়েছে, আগামী তিন বছরে ১ কোটি চাষিকে প্রাকৃতিক চাষাবাদ গ্রহণে সহায়তা করা হবে। কিন্তু কোন ম্যাজিকে এই সংখ্যা বাড়বে তার কোনো সদুত্তর বাজেট ভাষণে নেই।

এই সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে দেশে প্রায় ৫৯ লক্ষ ১০হাজার হেক্টর জমি জৈব চাষের অধীনে রয়েছে, যা মোট কৃষিকাজের এলাকার মাত্র ৪ শতাংশ।

আমরা জানি, গত কয়েক বছরে কেন্দ্র এবং কয়েকটি রাজ্যের সমস্ত বড় ঘোষণা সত্ত্বেও, রাসায়নিকমুক্ত চাষ এখনও মূলধারার চাষ হিসেবে স্বীকৃত হয়নি, সরকারের সদিচ্ছার অভাবে। কারণ সমস্ত আলোচনা সত্ত্বেও, জৈব বা প্রাকৃতিক চাষে বরাদ্দ, রাসায়নিক চাষের জন্য বরাদ্দের তুলনায় নগন্য। এ বছরেও এর কোনো ব্যত্যয় হবে বলে মনে হয় না।

এর আগে মহা ধুমধাম করে ন্যাশনাল মিশন অন ন্যাচারাল ফার্মিং-এর কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। এই মিশনেরও কী হবে তা নিয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না, কারণ বাজেটে এ নিয়ে কোনো কথাই বলা হয়নি।

বাজেটে প্রাকৃতিক চাষের উপযোগী সার, কীটরোধক তৈরির জন্য বায়ো-ইনপুট রিসোর্স সেন্টার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করা হয়েছে। মোট ১০ হাজার এরকম ছোটখাট বায়ো-ইনপুট রিসোর্স সেন্টার স্থাপন করা হবে। এদের নিয়ে একটি জাতীয় স্তরের ক্ষুদ্র সার ও কীটরোধক নেটওয়ার্ক তৈরি করার কথাও বলা হয়েছে।

রাসায়নিক নির্ভর চাষ থেকে জৈব চাষে ফিরতে চাষিদের বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে ধারণার অভাব, মানসম্পন্ন জৈব সামগ্রীর অভাব, ন্যায্য ও লাভজনক দাম পাওয়ার সমস্যা আর বাজারে অংশগ্রহণের সুযোগের অভাব। স্টেট অব বায়োফার্টিলাইজার অ্যান্ড অরগানিক ফার্টিলাইজার ইন ইন্ডিয়া নামে একটি সমীক্ষায়, দেশে জৈব সার এবং অন্যান্য জৈব সামগ্রীর দুর্বল অবস্থা তুলে ধরেছে। আর তাই জৈব বা প্রাকৃতিক চাষে চাষিদের সহায়তা করার জন্য বায়ো-ইনপুট রিসোর্স সেন্টারের খুব প্রয়োজন। অর্থমন্ত্রী ওপরের সমীক্ষা মতো সে কথাই বাজেট ভাষণে বলেছেন। কিন্তু টাকার বরাদ্দ করেননি।

প্রকৃতির পুনরুদ্ধার, এ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি আর পুষ্টির উন্নতির জন্য দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাটি হল পিএম-প্রণাম। এই প্রকল্পের অধীনে, রাজ্যগুলিকে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমাতে উৎসাহিত করা হবে। কোনো রাজ্য এই কর্মসূচি নিলে রাসায়নিক সারের ভরতুকির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের যতটা খরচ কম হবে, তার কিছু অংশ রাজ্য বা তার সংস্থা পাবে। এই টাকা দিয়ে তারা জৈব সামগ্রী উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করতে পারবে। কিন্তু যে রাজ্য রাসায়নিক সার ব্যবহার করবে না তাদের তো রাসায়নিক সারের দাম, ভরতুকির অর্থ এবং সঙ্গে উৎসাহ ভাতা দেওয়া দরকার। কিন্তু তা না করে ভরতুকির একটা অংশ রাজ্যকে দেওয়া হবে! এতে কোন রাজ্য জৈব চাষে উৎসাহিত হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা হল গোবর্ধন প্রকল্প। এর আওতায় ৫০০টি নতুন 'ওয়েস্ট টু ওয়েলথ' বা বর্জ্য থেকে সম্পদ তৈরির কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এর মধ্যে ২০০টি কম্প্রেসড বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট এবং ৩০০টি সামূহিক বা ক্লাস্টার বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট তৈরি করবে। এই প্ল্যান্ট তৈরি, তার থেকে জৈবসার সংগ্রহ এবং বিতরণের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।

জোয়ার, বাজরা এবং ছোট দানাশস্য বা মিলেটকে ভারতে শ্রী অন্ন বলে। এই শ্রী অন্ন বা মিলেটের একটি গ্লোবাল হাব ভারতে করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। একাজে হায়দ্রাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ মিলেট রিসার্চ, সেন্টার অব এক্সেলেন্স হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। মিলেট চাষে কম জল এবং সার লাগে। এর পাশাপাশি এইসব ফসল স্বাস্থ্যকর। তবে এজন্য সুনির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ করা হয়নি।

বাজেট ভাষণে অর্থমন্ত্রী এগ্রিকালচার অ্যাক্সিলেটর ফান্ড নামে একটি তহবিল তৈরির কথা বলেছেন। যার মাধ্যমে চাষিদের সমস্যা সমাধানের জন্য সৃজনশীল এবং উপযোগী উদ্ভাবনগুলিকে সহায়তা করা হবে। এই ফান্ডের মাধ্যমে কৃষিকাজে আধুনিকিকরণ, উৎপাদন এবং লাভ বৃদ্ধির নতুন প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং প্রসারে সহায়তা করা হবে। এই ফান্ডের ব্যবহার কোন খাতে হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। এক্ষেত্রে সরকারকে আরো নির্দিষ্টভাবে রাসায়নিক বিষমুক্ত প্রাকৃতিক কৃষির জন্য অর্থ বরাদ্দ করা দরকার ছিল।

সমবায়গুলিকে সক্ষম করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে মন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেন। সমবায়ের মধ্যে যেহেতু প্রাথমিক কৃষি ঋণদান সমিতি বা প্যাক্সগুলি পড়ে, সেজন্য জৈব বা প্রাকৃতিক চাষিদের বাজার তৈরির কাজে সহায়তার জন্য এই বহুমুখী কৃষি সমবায়গুলিকে যুক্ত করা দরকার। কিন্তু এক্ষেত্রেও কোনো উচ্চবাচ্য সরকার করেনি।

এর আগে, সরকার ঘোষণা করেছিল যে আমুল, চাষিদের সাহায্যের জন্য তাদের উৎপাদিত প্রাকৃতিক কৃষিপণ্যের বিপণন, সরবরাহের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরিক্ষা করবে। কিন্তু এই কর্মসূচি কতটা এগিয়েছে তার কোনো তথ্য এবছরের বাজেট ভাষণে অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেননি।

সরকার যে প্রাকৃতিক কৃষিকাজে গুরুত্ব দিচ্ছে তাকে স্বাগত জানাতে হবে। কিন্তু চাষ ও চাষিদের নিয়ে এই সরকারের ভূমিকা খুবই নেতিবাচক। তাই ঘোষণা অনেক হলেও, এখনও অবধি সরকারকে ভরসাও খুব একটা করা যাচ্ছে না।  

ফেব্রুয়ারি - ২৩, ২৮-৪৪, চাষ, জৈব চাষ

Comments

Popular posts from this blog

লিঙ্গসাম্যের দিকে এগোচ্ছে দেশ

পারম্পরিক জ্ঞানের তথ্যায়ন

দাঁতের ব্যথায় লবঙ্গ