পরিবেশ সম্মেলনের ৫০ বছর আর লোভের উন্নয়ন

অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি আর লাভ ও লোভের উন্নয়ন থেকে সরে আসা তো দূর, পরিবেশ সম্মেলনের সুবর্ণ জয়ন্তী পার হলেও, দেশগুলি আরো জোর কদমে সে দিকেই ছুটেছে... লিখছেন সুব্রত কুণ্ডু


 ১৯৭২ সালের ৫-১৬ জুন। রাষ্ট্রসংঘের আহ্বানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম পরিবেশ সম্মেলন। উদেশ্য পরিবেশ, বায়ু, জল, মহাসাগরের দূষণ রোধ করতে একটি পরিবেশ কর্মসূচি তৈরি। পৃথিবীর প্রায় সব দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে এই সম্মেলন করা হয়েছিল এক প্রকার চাপে পড়ে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে বিষাক্ত এজেন্ট অরেঞ্জের ব্যবহার এবং পরিবেশ ও মানুষের ওপর তার প্রভাব; বিষাক্ত ডিডিটির ব্যবহার নিয়ে লেখা রাচেল কার্সনের বই ‘দ্য সাইলেন্ট স্প্রিং’; ইন্টারমিডিয়েট টেকনোলজি এবং ই এফ স্যুমাখারের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধির উন্নয়ন নিয়ে নানা লেখা; আর সর্বোপরি ‘লিমিটস অব গ্রোথ’ নামে লেখা, ক্লাব অব রোমের রিপোর্ট চিন্তায় ফেলেছিল বিভিন্ন দেশ এবং রাষ্ট্রসংঘের কর্তাদের। এই রিপোর্টে ক্রমশ বদলে যাওয়া জনসংখ্যা, খাদ্য উৎপাদন এবং শিল্পায়ন ও তার অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। উন্নয়নের নামে এই বৃদ্ধির জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির যথেচ্ছ ব্যবহার, আর তার থেকে পরিবেশ দূষণের বিপজ্জনক অবস্থার কথা রীতিমত অংক কষে তথ্য তুলে ধরা হয়েছিল রিপোর্টটিতে। ক্লাব অব রোম তাদের রিপোর্টে মোদ্দা কথাটা বলেছিল যে, প্রাণ বৈচিত্রে ভরপুর পৃথিবী একটাই। আর ফের ব্যবহার করা যায় এরকম সম্পদও সীমিত। এটা জানার পরও যদি অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধির লোভ না ছাড়তে পার তবে ‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে’।

সম্মেলন হল। ঠিক হল একটি পরিবেশ কর্মসূচি তৈরি হবে, যা সব দেশ মেনে চলবে। সম্মেলনের উদ্বোধনের দিন ৫ জুনকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হল। দেশে দেশে নানা আইন-নিয়ম-নীতি তৈরি হল। পরিবেশে যে সমস্যাগুলি আগে জানা ছিল না, তাও এক এক করে সামনে আসতে লাগল। রাসায়নিক থেকে দূষণ, প্লাস্টিক থেকে দূষণ, বিভিন্ন বর্জ্যের দূষণ ইত্যাদি। আর এখন সবথেকে বড় সমস্যা জলবায়ু বদল। বোঝা যাচ্ছে নানা সভা, সমিতি, সম্মেলন হয়েছে। নীতি, আইনকানুন তৈরি হয়েছে। কিন্তু অনিয়িন্ত্রিত বৃদ্ধি আর লাভ ও লোভের উন্নয়ন থেকে সরে আসা তো দূর, পরিবেশ সম্মেলনের সুবর্ণ জয়ন্তী পার হলেও, দেশগুলি আরো জোর কদমে সে দিকেই ছুটেছে।

এর মধ্যেই গ্লোবাল ফুট প্রিন্ট নেটওয়ার্ক তাদের ২০১৯ সালের রিপোর্টে বলেছে, পৃথিবীর সব মানুষ যদি মার্কিনীদের মতো সম্পদ ব্যবহার করতে শুরু করে, তবে সেই সম্পদ জোগাতে দরকার মোট পাঁচটি পৃথিবী। জার্মানীদের মতো সম্পদ ব্যবহার করলে লাগবে তিনটি। আর ভারতীয়দের মতো ব্যবহার করলে লাগবে দেড়খানা পৃথিবী। আবহাওয়া, জলবায়ু, দূষণ কোনো সীমা পরিসীমা মানে না। আর তাই, আমেরিকায় দূষণ হলে আমাদের ওপরও তার প্রভাব পড়বে। ফলে বিপদ সবার।

আমাদের কাজকর্মের ফলে এখন যে গ্রিন হাউস গ্যাস, বিশেষত কার্বন, নির্গমন হচ্ছে তাতে প্রাক-শিল্প সভ্যতার সময়ে যে তাপমাত্রা ছিল, তার থেকে এই শতাব্দীর শেষে, তাপমাত্রা পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। এটা পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন। তারা আরো বলছেন, যদি টিকে থাকতে হয়, তবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম রাখতে হবে। ২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত শীর্ষ পরিবেশ সম্মেলনে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল।

হয়তো জানেন, আবার একটা পরিবেশ সম্মেলন হতে চলেছে মিশরের শার্ম আল শেখ শহরে। ইতিমধ্যেই অন্যান্য দেশের মত আমাদের প্রধানমন্ত্রী অনেক কিছু ঘোষণা করছেন। বলেছেন ২০৭০ সালের মধ্যে ভারত কার্বন নির্গমন সম্পূর্ণ বন্ধ করবে। পাশাপাশি দেওয়া হচ্ছে কয়লা, পেট্রোলিয়াম তোলার অবাধ ছাড়পত্র। বনধ্বংস করে শিল্প গড়ার অনুমোদন।

২০০৮ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর ইকুয়েডরের মানুষ ভোট দিয়ে তাদের নতুন সংবিধান অনুমোদন করেছে। সেই সংবিধানে বলা হয়েছে। প্রকৃতির অধিকার তাদের সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর প্রকৃতি তার পর্বত, নদী, বন, বায়ু, জল, এবং দ্বীপগুলির অস্তিত্ব রক্ষা, তার সুস্থিতি এবং বিকাশের পুর্ণ আইনগত অধিকার রয়েছে। সম্প্রতি চিলিতেও একইরকম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শুধু ঘোষণা করে তাই কোনো সমস্যার সমাধান হবে না। লাভ ও লোভের উন্নয়নের পথ ছেড়ে পরিবেশমুখী, মিতব্যয়ী এবং সাম্যের উন্নয়নে মনোনিবেশ করতে হবে। অন্যাথায় পৃথিবী থাকবে, প্রকৃতি থাকবে, আমরা থাকব না, থাকবে না আমাদের সন্তান সন্ততিরা…

সেপ্টেম্বর - ২২, ২৮-১৯, পরিবেশ, জলবায়ু বদল

Comments

Popular posts from this blog

রক্তচাপ কমায় টম্যাটো

সার থেকে ক্যান্সার

আচ্ছে দিন