পরিবেশঃ অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে

এনভায়রনমেন্ট পারফরমেন্স ইনডেক্স অনুযায়ী ২০৫০ সালের মধ্যে ভারত গ্রিনহাউস গ্যাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম নির্গমনকারী হবে


২০২২ সালে এনভায়রনমেন্ট পারফরমেন্স ইনডেক্স বা ইপিআই প্রকাশিত হয়েছে। এই ইন্ডেক্স অনুযায়ী ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৮০ তম। ভারতের আগে রয়েছে বাংলাদেশ ১৭৭ এবং পাকিস্তান ১৭৬ নম্বরে। এই তালিকায় শীর্ষ পাঁচটি দেশ হল ডেনমার্ক, যুক্তরাজ্য, ফিনল্যান্ড, মাল্টা এবং সুইডেন। প্রতিবেদন অনুসারে বিপজ্জনক দূষিত বাতাস শোধন এবং দ্রুত বাড়তে থাকা গ্রিনহাউস গ্যাস কমানো ভারতের কাছে জরুরি চ্যালেঞ্জ।

পরিবেশকে সুস্থ করার নানা রকম সরকারি প্রতিশ্রুতি আমরা অহরহ শুনি। সম্প্রতি জি-৭ গোষ্ঠীর সভায়ও জলবায়ু বদল নিয়ে বলেছে প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এই রিপোর্ট বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে ভারত গ্রিনহাউস গ্যাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম নির্গমনকারী হবে। প্রথমে থাকবে চিন।

ইপিআই অনুসারে জৈব বৈচিত্রে আমারা ১৭৯, বাতাসের গুণমানে ১৭৯, ওজোন নির্গমনে ১৭৯, বাস্তুসংস্থান এবং তার জীবনীশক্তির ক্ষেত্রে ১৭৮ এবং স্বাস্থ্যে ১৭৮তম স্থানে রয়েছি। উল্লেখ্য, ২০২০ সালে, এই সূচক অনুযায়ী ভারত ছিল ১৬৮ নম্বরে। অর্থাৎ করোনা কালে পরিবেশ আরো খারাপ হয়েছে। যথারীতি ভারত সরকার এই রিপোর্টের বিরোধিতা করে বলেছে, এই গণনা ভুলে ভরা। এছাড়া ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে যে বিষয়গুলি গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল সেগুলি প্রাধান্য পায়নি।

এনভায়রনমেন্ট পারফরমেন্স ইনডেক্স বা ইপিআই একটি আন্তর্জাতিক র‌্যাঙ্কিং সিস্টেম যা দিয়ে প্রতি দু বছর অন্তর দেশগুলির পরিবেশগত স্বাস্থ্য এবং স্থায়িত্ব মাপা হয়। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ২০০২ সালে এই পরিমাপ শুরু করে। বর্তমানে ইয়েল সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল ল অ্যান্ড পলিসি এবং সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল আর্থ সায়েন্স ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি এই কাজ যুক্ত।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, পরিবেশর স্বাস্থ্য এবং বাস্তুতন্ত্রের জীবনীশক্তির ওপর ১১ টি বিষয়ে ৪০টি সূচক ব্যবহার করে ১৮০টি দেশের ইপিআই মাপা হয়। বিভিন্ন দেশ এই ইপিআই-এর প্রস্তাব মতো সুস্থায়ী উন্নয়ন লক্ষ্য (বা সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল) অর্জনে উদ্যোগ নেয়।

ইপিআইতে, ভারতের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করে -
  • সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেনের যৌগ, কার্বন মনোক্সাইড এবং উদ্বায়ী জৈব পদার্থ নির্গমনের ওপর নজরদারিতে আরো গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
  • প্লাস্টিক দূষণের পরিমাপ করে তার ব্যবস্থাপনা এবং সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণ কমানোর জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দরকারি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
  • সুস্থ সমাজের উন্নয়নে বিষমুক্ত কৃষির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে এই রিপোর্টে বলা হয়েছে। এজন্য ইপিআইতে সুস্থায়ী রোগ-পোকা নিয়ন্ত্রণের নির্দিষ্ট কর্মসূচির কথা বলা হয়েছে।
এতো গেল ইপিআই-এর কথা। পরিবেশ সংক্রান্ত যে কটি সূচক প্রকাশিত হয় তার প্রত্যেকটিতে ভারত পিছিয়ে রয়েছে। এমনকী প্রতিবেশী দেশগুলি থেকেও আমরা পেছিয়ে রয়েছি। কার্বন ডাই অক্সাইড এমিশন বা নির্গমনের তালিকায় ২০১টি দেশের মধ্যে আমাদের স্থান ৩ নম্বরে। ভাববেন না এটা ভালো। আমরা তৃতীয় দেশ যারা পরিবেশে সবথেকে বেশি কার্বন নির্গত করি। আমাদের আগে রয়েছে চিন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তবে এটা ঠিক যে, জনপ্রতি কার্বন নির্গমনের ক্ষেত্রে ২১৪টি দেশের আমরা মধ্যে ১৪৫তম। ২০১৮ সালে এদেশের জনপ্রতি কার্বন নির্গমনের পরিমাণ ছিল বছরে ১৮০০ কেজি। একই সময়ে চিনে তা ৭৪১০ কেজি, আর মার্কিন দেশে জনপ্রতি ১৫২৪০ কেজি। এখানে গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা হল, যেহেতু আমাদের দেশের জনসংখ্যা বেশি, তাই জনপ্রতি এই গ্যাস নির্গমনের পরিমাণ কম দেখাচ্ছে। তবে ওপরতলার ১০ শতাংশ বা প্রায় ১৪ কোটি লোক যে কার্বন ডাই অক্সাইড পরিবেশে নির্গত করছে তার পরিমাণ মার্কিনিদের থেকে কোনো অংশে কম হবে না।

জার্মান ওয়াচ বলে একটি সংস্থা গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইন্ডেক্স প্রকাশ করে। জলবায়ু বদলের জন্য কোন দেশ কতটা ঝুঁকিতে রয়েছে তা এই সূচক থেকে বোঝা যায়। তাদের ২০২১-এর রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ভারত এই তালিকায় ১০ নম্বরে রয়েছে। অর্থাৎ আমাদের ঝুঁকি অনেক বেশি। অন্যদিকে আমাদের ইকোলজিকাল ফুটপ্রিন্ট বা পরিবেশ পদাঙ্ক ক্রমশ বাড়ছে।

এগুলি নয় বিদেশি সংস্থার করা রিপোর্ট। কিন্তু দেশের সংস্থা সেন্টার ফর সায়েন্স এন্ড এনভায়রনমেন্ট সরকারেরই তথ্য বিশ্লেষণ করে কী বলছে একটু দেখে নেওয়া যাক।

কৃষি

২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। যদিও একটি কৃষি পরিবারের গড় মাসিক আয় ৬,৪২৬ টাকা থেকে বেড়ে ১০,২১৮ টাকা হয়েছে। কিন্তু আয় বেড়েছে মূলত মজুরি বৃদ্ধি এবং পশুপালন থেকে আয়ের কারণে।

২০১২-১৩ সালে একটি কৃষি পরিবারের গড় মাসিক আয়ে, শস্য উৎপাদন থেকে আয়ের অংশ ছিল ৪৮ শতাংশ। ২০১৮-১৯ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৭.২ শতাংশে।

বায়ু দূষণ

লক্ষ্য ছিল, ভারতীয় শহরগুলিতে পার্টিকুলেট ম্যাটার (ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দূষণ কণা) পিএম (PM) ২.৫ এর মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ৫০ মাইক্রোগ্রামের কমে (µg/m3) নামিয়ে আনা। ২০২০ সালে মহামারির কারণে যানবাহন চলাচল সীমিত হয়েছিল – এটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু তখনও দেশের ১২১টি শহরে মধ্যে ২৩টি শহরে পিএম ২.৫ এর মাত্রা ৫০ µg/m 3 অতিক্রম করেছিল।

কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

লক্ষ্য ছিল, সমস্ত পরিবারের শতভাগ কঠিন বর্জ্য বাড়িতেই আলাদা করার ব্যবস্থা করা। একাজে সামগ্রিক অগ্রগতি ৭৮ শতাংশ। কেরালার এবং পুদুচেরি এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। পশ্চিমবঙ্গ এবং দিল্লিসহ এবং অন্য সব রাজ্য একাজে বেশ খানিকটা পিছিয়ে রয়েছে।

বনভূমি

জাতীয় বন নীতি, ১৯৮৮-এ, ভৌগোলিক এলাকার ৩৩.৩৩ শতাংশ বা দেশের এক তৃতীয়াংশ এলাকায় বনভূমি তৈরি ও সংরক্ষণ করার লক্ষ্য রাখা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৯ সালের হিসেব অনুযায়ী ভারতের ২১.৬ শতাংশ অঞ্চলে রয়েছে বনভূমি। উল্লেখ্য, সরকারি হিসেবে যতটা এলাকায় বনসৃজনের জন্য চারা রোপণ করা হয়, তাও বনভূমির আওতায় ধরা হয়। অন্যদিকে বন তৈরির জন্য যে কৃত্তিম পদ্ধতি নেওয়া হয় এবং যেসব প্রজাতির চারা রোপণ করা হয় তা নিয়েও বিতর্ক হয়েছে। অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ম্যানগ্রোভ বা বাদাবন অথবা চিরহরিৎ বন নষ্ট করে আকাশমণি বা ইউক্যালিপটাশের বন তৈরি হলে তাকে কি সত্যিই বন বলা চলে! এসব তথ্য থেকে বোঝা যাচ্ছে দেশে বনের অবস্থা বেশ সঙ্গীন।

শক্তি

লক্ষ্য ছিল ২০২২ সালের মধ্যে ১৭৫ গিগাওয়াট নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন ক্ষমতা অর্জন করা। এই লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৫৬ শতাংশ এ পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে।

সুস্থায়ী উন্নয়ন লক্ষ্য

২০১৫ সালে রাষ্ট্রসংঘের ১৯২ টি সদস্য দেশ ২০৩০ সালে মধ্যে অর্জনের জন্য ১৭টি সাস্টেনেবল ডেভলপমেন্ট গোল বা সুস্থায়ী উন্নয়ন লক্ষ্য স্থির করেছিল। ২০২২ সালে এই লক্ষ্যের তালিকায় ভারত ১১৭ থেকে ১২০ নম্বরে নেমে এসেছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও আমরা পিছিয়ে পড়ছি।

ভারত সরকারের পক্ষ থেকে একটা রেওয়াজ হল, সমালোচনা থাকলেই প্রায় সব রিপোর্টকে ভুল, পক্ষপাত দুষ্ট, ভিত্তিহীন, অনুমানে ভর করে তৈরি - ইত্যাদি বলে সেগুলিকে খারিজ করে দেওয়া হয়। ইপিআই-এর ক্ষেত্রও একই কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে !

সুব্রত কুণ্ডু

জুলাই - ২২, ২৮-০৫, পরিবেশ, দূষণ

Comments

Popular posts from this blog

রক্তচাপ কমায় টম্যাটো

সার থেকে ক্যান্সার

আচ্ছে দিন