সুখের কথা বোলো না আর…
সুখ আর প্রকৃতি পরিবেশের সম্পর্ক নিয়ে
লিখছেন সুব্রত কুণ্ডু
মানুষজন কতটা সুখী তা জানা যায় ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট থেকে। গত মার্চে, দোলের দিন, এবছরের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। এই রিপোর্ট কিন্তু ভারতের নাগরিকদের খুশীতে রাঙিয়ে দিতে পারেনি। কারণ সুখের তালিকার ১৪৬টি দেশের মধ্যে আমাদের স্থান ১৩৬ নম্বরে। একদম শেষের দিকে। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে লেগেছে, যখন দেখা গেছে প্রতিবেশী সব দেশ আমাদের থেকে ‘বেশি সুখে’ আছে। চিন ৮২, নেপাল ৮৫, বাংলাদেশ ৯৯, পাকিস্তান ১০৩, মায়নামার ১২৩, শ্রীলঙ্কা ১২৬ নম্বরে। অন্যান্য সব সূচক বা তালিকার মতোই ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, সুইৎজারল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ‘উন্নত’ দেশগুলি সুখের তালিকারও ওপরের দিকে রয়েছে। রাষ্ট্রসংঘের সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশন নেটওয়ার্ক এই রিপোর্টটি পেশ করে। রিপোর্ট তৈরির প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের ফোন করে জানতে চাওয়া হয়, তাঁরা সুখী কি না। পাশাপাশি হিসেবনিকেশ চলে সমীক্ষাধীন দেশগুলির আর্থিক বৃদ্ধির হার, দেশবাসীর গড় আয়ু, সামাজিক সহায়তা, কাজ করার স্বাধীনতা, দুর্নীতি ইত্যাদি বিষয়ে। এছাড়া ব্যক্তি স্বাধীনতা, সরকারের উপর আস্থা, সুস্থ জীবনযাপনের প্রত্যাশার মতো মাপকাঠিও রাখা হয় সুখ মাপতে। উল্লেখযোগ্য হল, এসব মাপকাঠিই অন্যান্য ‘উন্নতি’র তালিকাতেও ব্যবহার করা হয়। আর তাই ‘উন্নত’ দেশই সুখী দেশ হয়ে যায়। পরোক্ষে বলা হয়, দেখ বাপু বর্তমান ভোগের উন্নয়ন মডেলেই তোমার সুখ লুকিয়ে রয়েছে।
নিউ ইকোনমিক ফাউন্ডেশন নামে লন্ডনের একটি সংস্থা হ্যাপি প্ল্যানেট ইন্ডেক্স নামে আরো একটি সমীক্ষা করে। ২০০৬ সাল থেকে তিন বছর অন্তর এই সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। ২০১৯ সালে শেষ হ্যাপি প্ল্যানেট ইন্ডেক্স-এর সুখী দেশের তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল। এই তালিকায় কিন্তু প্রথম সারিতে রয়েছে কোস্টারিকা, ভানুয়াটু, কলম্বিয়া, সুইৎজারল্যান্ড, ইকুয়েডর, পানামা, জামাইকা, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, উরুগুয়ে। তবে এখানেও ভারতের স্থান নীচের দিকে - ১৫২টি দেশের মধ্যে ১২৮। আরো অবাক করা বিষয় হল, অন্যান্য এবং ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস তালিকায় এগিয়ে থাকা দেশগুলি যেমন ফিনল্যান্ড রয়েছে ৩৩ নম্বরে। ডেনমার্ক ৭০, আইসল্যান্ড ৫২, সুইডেন ৪১, নরওয়ে ৩৮, কানাডা ১০৫, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১২২ নম্বরে।
হ্যাপি প্ল্যানেট ইনডেক্স (HPI) হল দীর্ঘস্থায়ী ভালো বা আনন্দে থাকার একটি মাপকাঠি যাকে ইংরাজিতে ‘সাস্টেনেবল ওয়েলবিয়িং’ বলে। এটা মাপা হয় তিনটি সূচকের মাধ্যমে।
- পরিতৃপ্ত জীবন - লোকেরা তাদের জীবন নিয়ে কতটা সন্তুষ্ট (এটা মাপা হয় গলাপ ওয়ার্ল্ড পোল পদ্ধতির মাধ্যমে)
- গড় আয়ু - মানুষ সাধারণত কতদিন বেঁচে থাকে (এই তথ্য নেওয়া হয় রাষ্ট্রসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি বা ইউএনডিপি সংগৃহীত তথ্য থেকে)
- ইকোলজিক্যাল ফুট প্রিন্ট বা পরিবেশ পদাঙ্ক - বিভিন্ন দেশের আয়তন এবং তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের ফলে পরিবেশের ওপর যে চাপ বা প্রভাব তৈরি হয় তার মাপকাঠি। এটা মাপা হয় গ্লোবাল হেক্টর দিয়ে (এই তথ্য নেওয়া হয় গ্লোবাল ফুটপ্রিন্ট নেটওয়ার্ক থেকে)।
বোঝার জন্য একটি সহজ উদাহরণ নেওয়া যাক। ধরা যাক ফিনল্যান্ড, যে দেশটি ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ইন্ডেক্সের ১ নম্বরে রয়েছে তার পরিতৃপ্ত জীবন মান এবং গড় আয়ুর গুণফল ৯০ আর কোস্টারিকার ৭০। কিন্তু পরিবেশ পদাঙ্ক অনুযায়ী ফিনল্যান্ডের প্রকৃতির ওপর প্রভাব বা চাপ ৯ এবং কোস্টারিকার ৫ গ্লোবাল হেক্টর। এবারে ভাগ করলে ফিনল্যান্ডের নম্বর হবে ১০। আর কোস্টারিকার নম্বর হবে ১৪। অর্থাৎ হ্যাপি প্ল্যানেট ইন্ডেক্স অনুযায়ী কোস্টারিকা এগিয়ে।
হ্যাপি প্ল্যানেট ইন্ডেক্স-এ জীবনধারণের গুণগত মান কতটা ভালো তার ওপর নির্ভর করে সুখী দেশের তালিকা তৈরি হয় না। এই সূচকে দেখা হয়, পরিবেশের ওপর সবথেকে কম চাপ বা প্রভাব ফেলে, কোন দেশ সবথেকে বেশি সংখ্যক মানুষকে দীর্ঘ এবং পরিতৃপ্ত জীবন দিতে পারছে।
উল্লেখ্য হ্যাপি প্ল্যানেট ইন্ডেক্স হল প্রথম সূচক যেখানে সুখে থাকার সঙ্গে এত ব্যাপকভাবে পরিবেশকে যুক্ত করা হল। আর মজার ব্যাপার হল, হ্যাপি প্ল্যানেট ইন্ডেক্স-এ থাকা দেশ কোস্টারিকা এবং ভানুয়াটুর সেনাবাহিনী নেই। সেনাবাহিনী নেই পানামারও।
সব সুখের সূচক নিয়ে সমালোচনাও রয়েছে বিস্তর। তার মধ্যে অন্যতম হল সুখের মত বিমূর্ত অনুভবকে কীভাবে মূর্ত জিনিস দিয়ে মাপা যাবে? তবে একথা সত্যি লাভ আর লোভের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার জন্য প্রকৃতি শোষণ চললে, প্রকৃতি মানুষের জীবনকে ক্রমশ দুর্বিসহ করে তুলবে। তুলবেই।
মে - ২২, ২৭- ৬৯, সুখের সূচক, পরিবেশ
Comments
Post a Comment