প্রাকৃতিক পুঁজির মাপকাঠি ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট


আমাদের চাহিদা মেটাতে, আর যে বর্জ্য আমরা তৈরি করি তা বিলীন হতে
 বা প্রকৃতিতে মিশে যেতে দেড় খানা পৃথিবী দরকার, লিখছেন সুব্রত কুণ্ডু


আমাদের চাহিদা মেটাতে, আর যে বর্জ্য আমরা তৈরি করি তা বিলীন হতে বা প্রকৃতিতে মিশে যেতে দেড় খানা পৃথিবী দরকার। গ্লোবাল ফুট প্রিন্ট নেটওয়ার্ক নামে একটি সংস্থা এসব হিসাবকিতাব করে। এর থেকে তারা প্রতিবছর আর্থ ওভারসুট ডে বলে একটা দিন ঠিক করে। আর্থ ওভারশুট ডে হল একটি দিন, যে দিনটির মধ্যে আমরা ওই বছরে আমাদের জন্য বরাদ্দ সম্পদ ব্যবহার করে ফেলি। ২০২১-এ এই দিনটি ছিল ২৯ জুলাই। ২০০০ সালে ওভারসুট ডে ছিল ২৩ সেপ্টেম্বর। আর ২০১০ থেকে ১৮ সালের মধ্যে এই দিনটি অগস্টের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই ঘোরাফেরা করেছে। ২০২০ তে আমরা পৃথিবীর সম্পদ কম ব্যবহার করেছিলাম করোনা মহামারির কারণে। তাই এই দিনটি পেছিয়ে হয়েছিল ২২ অগস্ট।

এই তথ্য বলছে, প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের পরিমাণ বাড়ছে। আর আমরা চাইলে এই সম্পদ ব্যবহার কমাতেও পারি। যদিও এই হিসেব নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে কিছু বিতর্ক আছে। তবে বেশিরভাগ বিজ্ঞানী স্বীকার করেন যে, এটি ভঙ্গুর উন্নয়ন ব্যবস্থাকে খুব ভালোভাবেই বোঝাতে পারে।

হিসেবটি আরেকটু সহজ করে বলা যাক। আপনি আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের কথা ভাবুন। ধরা যাক, ব্যাংক অ্যাকাউন্টটিতে আপনার আয় জমা আছে যা সারা বছর ধরে খরচ হবে। অন্য কোনো আয় আপনার নেই। কিন্তু ওই অ্যাকাউন্ট থেকে সব টাকা ২৯ জুলাইয়ের মধ্যে খরচ হয়ে যাচ্ছে। তাহলে বছরের বাকি দিনগুলি কীভাবে চলবে? হয় ঋণ নিয়ে বা আপনার বা পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া পুঁজিপাটা ভেঙে। তাইতো? প্রকৃতির ক্ষেত্রে ঋণ নিয়ে শোধ দেওয়ার কিছু নেই। পুরোটাই পুঁজি ভেঙে খাওয়া। এক্ষেত্রে আমাদের লাভ বা লোভের সংস্কৃতির জন্য পরের প্রজন্মকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছি।

এই যে এতো হিসেবের কথা বলা হচ্ছে, সে হিসেব মাপা হয় ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট বা প্রাকৃতিক পদাঙ্ক দিয়ে। সংক্ষেপে, প্রাকৃতিক পদাঙ্ক হল, প্রকৃতির উপর মানুষের প্রভাব বের করার একটি পরিমাপ।

আরো একটা বিষয় হল বায়োক্যাপাসিটি বা জৈবিক ধারণ ক্ষমতা। আমাদের চাহিদা মেটাতে, আর যে বর্জ্য তৈরি করি তা বিলীন হতে বা প্রকৃতিতে মিশে যেতে যতটা উৎপাদনক্ষম জায়গা লাগে সেটাকে বলে বায়োক্যাপাসিটি বা জৈবিক ধারণ ক্ষমতা। এই জৈবিক ধারণ ক্ষমতা এবং প্রাকৃতিক পদাঙ্ক মাপা হয় গ্লোবাল হেক্টর দিয়ে।

এবার আর একটু বিশদে বোঝা যাক বায়োক্যাপাসিটি এবং ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্টের ভারসাম্যের সম্পর্ক। ভারতের বায়োক্যাপাসিটি হল ০.৪৫ গ্লোবাল হেক্টর। অর্থাৎ প্রতিটি ভারতীয়ের চাহিদা মেটাতে, আর তার তৈরি বর্জ্য প্রকৃতিতে বিলীন হওয়ার জন্য রয়েছে গড়ে ০.৪৫ গ্লোবাল হেক্টর উৎপাদনক্ষম জায়গা। আর ২০২১ সালে গড় ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট হল ১.১৬ গ্লোবাল হেক্টর। এই হিসেব অনুযায়ী আমাদের দেশে যতটা উৎপাদনক্ষম জায়গা রয়েছে তার থেকে .৭১ বেশি গ্লোবাল হেক্টর জায়গার সম্পদ আমরা ব্যবহার করছি।

আবার কানাডার বায়োক্যাপাসিটি হল ১৬.০১ আর ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট ৮.১৭। তাহলে কানাডা তাদের উৎপাদনক্ষম জায়গার থেকে ৭.৮৪ কম গ্লোবাল হেক্টর ব্যবহার করছে। এই হিসেবে তাহলে, ভারতীয়রা কানাডাবাসীর তুলনায় কম প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করলেও তাদের অবস্থা খুব খারাপ। আর কানাডার নাগরিকদের অবস্থা অনেকটাই ভালো ! না এটা সম্পূর্ণ সত্যি নয়। কারণ পৃথিবীর গড় বায়ো ক্যাপাসিটি হল ১.৬৩ গ্লোবাল হেক্টর। আর ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট ২.৭৩ গ্লোবাল হেক্টর। মানে সারা পৃথিবীর প্রাকৃতিক পুঁজি ক্রমশ শেষ হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং বিপদে সবাই। এবং এই বিপদের জন্য দায়ি তারাই যারা লাগামছাড়া প্রাকৃতিক শোষণ করছে।

সম্প্রতি স্কটল্যান্ডের গ্লাসগ্লো শহরে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল কপ – ২৬ বা ক্লাইমেট চেঞ্জ কনফারেন্স। এর আগে এরকম ২৫টি জলবায়ু বদল নিয়ে সম্মেলন হয়ে গেছে। এছাড়া আরো অনেক রকম সভা সমিতি হয় পৃথিবী জুড়ে। সেখানে বিভিন্ন দেশ নেতারা জলবায়ু বদল রুখতে নানা প্রতিশ্রুতি দেন। সেসব নিয়েই তৈরি হয় নানা রকম উন্নয়ন লক্ষ্য। যদিও তার বেশিরভাগটাই পালন হয় না। হয় না তার কারণ, এই যে ভঙ্গুর উন্নয়ন প্রক্রিয়া, তার থেকে কেউই সরে আসতে চায় না। আর তাই দেশগুলির ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট বাড়তে থাকে।

যে কথা বলছিলাম। বহুবছর ধরে শান্তি, নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ইত্যাদি কথা বলে আমরা গোটা পৃথিবীটাকেই ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়েছি। নানারকম বেড়া তৈরি করেছি, ‘অপরদের’ আটকানোর জন্য। এরজন্য নানা রাজনৈতিক, আর্থিক, সামাজিক যুক্তি খাড়া করা হয়েছে। লক্ষ্য, লাভ ও লোভের ভঙ্গুর উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে টিকিয়ে রাখা। শিল্প সভ্যতার ২৫০ বছরের মধ্যে প্রায় ২০০টি রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে। এর আগে বর্তমান রাষ্ট্রের ধারণাই ছিল না।

এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতে আরো টুকরো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে পৃথিবীর, প্রকৃতির। তবে একটা কথা বোঝা দরকার, রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্রে যেতে আমাদের ভিসা, পাসপোর্ট, অনুমতি লাগে। পশুপাখির লাগে না। জল, হাওয়ার লাগে না। তাই কোথাও প্রাকৃতিক চক্রগুলি ভেঙে পড়লে, প্রকৃতি দূষিত হলে, তার প্রভাব পড়ে অন্য রাষ্ট্রে। প্রভাব পড়ে সারা পৃথিবীতে, প্রকৃতিতে এবং তার ওপর নির্ভর করে থাকা সমগ্র জীবকূলের ওপর। যে জন্যই পৃথিবী গরম হচ্ছে। দ্রুত জলবায়ু বদল হচ্ছে। একদিকে বরফ গলে যাচ্ছে। অন্যদিকে সমুদ্র ফুলে ফেঁপে উঠছে। তার ফল ভোগ করছে সমগ্র জীবকূল।

বেঁচেবর্তে থাকতে হলে তাই ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট কমানো ছাড়া এখন আর কোনো উপায় নেই। সেজন্যই লাভ ও লোভের ভঙ্গুর উন্নয়ন প্রক্রিয়া এবং ভোগের সংস্কৃতি থেকে রাষ্ট্রকে, সমূহকে, ব্যক্তিকে দূরে সরতে হবে। হবেই।

জানুয়ারি -২২, ২৭- ৪৪, উন্নয়ন, পরিবেশ, বৈষম্য


Comments

Popular posts from this blog

লিঙ্গসাম্যের দিকে এগোচ্ছে দেশ

পারম্পরিক জ্ঞানের তথ্যায়ন

দাঁতের ব্যথায় লবঙ্গ