বাজারের চুক্তি চাষে আনন্দে চাষি !

চুক্তি চাষে কৃষকের লাভ। মোটামুটি এই শিরোনামে সর্বাধিক প্রচারিত এক দৈনিকে কয়েকদিন আগে এক সাংবাদিক লিখেছিলেন। সেখানে বলা হয়েছিল, চুক্তিতে আলু চাষ করে চাষিরা অনেক লাভ করছে। এবছর ৯৪০ টাকা কুইন্ট্যাল দরে আলু মাঠ থেকে কিনে নিচ্ছে ভেন্ডারেরা। অতএব চুক্তি চাষ নিয়ে যেসব বিরোধ হচ্ছে সেগুলি অবান্তর। খুবই ভালো কথা। কিন্তু কত লাভ হচ্ছে, তার কোনো হিসেব দেওয়া হয়নি। বর্ধমান, হুগলি, বাঁকুড়ার চুক্তিতে এবং চুক্তি ছাড়া আলুর চাষ করে এরকম কয়েকজন চাষির সঙ্গে কথা জানা গেল – সাধারণ আলু চাষে বীজ, সার, বিষ, সেচ, শ্রমসহ সব ধরে এবারে গড়ে ২৩ হাজার টাকা খরচ হয়ছে বিঘায় (৩৩ শতক)*। কারণ এবারে এক বস্তা বীজের দাম ৪৮০০ থেকে ৫ হাজার টাকা উঠেছিল। অন্যদিকে চুক্তি চাষে এলআর, আর এফসি এই দুই জাতের চাষ হয়। এক্ষেত্রে খরচ হয়েছিল ১৯ হাজার ৫০০ টাকা। কারণ এলআর বা এফসি বীজ আলুতে গাছ হওয়ার মত ‘চোখ’ কম হয়। ফলে এই বীজ-এর পরিমাণ বেশি লাগে। চাষিদের মতে, এক বিঘা জ্যোতি আলু চাষে যেখানে ৫০ কেজি বস্তার কমবেশি আড়াই বস্তা বীজ লাগে। সেখানে চুক্তির আলু বীজ লাগে ৫ বস্তা। এবছর এই বীজের দাম ছিল ১৮০০ টাকা বস্তা। অর্থাৎ জ্যোতি আলুতে যেখানে বিঘা প্রতি সাড়ে ১২ হাজার টাকার বীজ লেগেছিল। চুক্তির আলুতে সেখানে লেগেছে ৯০০০ টাকার বীজ।

জ্যোতি আলুতে গড়ে ৮০-৯০ বস্তা আলু ফলে অর্থাৎ কমের দিকে ধরলে ৪০ কুইন্ট্যাল আলু হয়। আর চুক্তির আলুতে ফলে ৬০-৭০ বস্তা। কমের দিকে ধরলে ৩০ কুইন্ট্যাল। ফলন কম হওয়ার কারণ হিসেবে চাষিরা বলেন জ্যোতি আলুর চাষের ভেলি/ভিটি ১৮ ইঞ্চি দূরে দূরে করা হয়। আর চুক্তির আলুতে কম করে দুরত্ব রাখতে হয় ২২ ইঞ্চি। ফলে জমির পরিমাণ কমে। উৎপাদনও কিছুটা কমে।

জ্যোতি আলুর ক্ষেত্রে সব সাইজের আলুই বিক্রি হয়। কিন্তু চুক্তির আলু নির্দিষ্ট মাপের বাইরে বিক্রি হয় না। অর্থাৎ ছোট বা খুব বড় আলু সাধারণত ভেন্ডাররা নেয় না। সেক্ষেত্রে বাদ দিয়ে ৫০-৬০ বস্তা আলু নিচ্ছে ভেন্ডারেরা ৯৪০ টাকা কুইন্ট্যাল দরে। বাঁকুড়ার ওন্দা ব্লকের পুরুষোত্তমপুর, কাঁটাবাড়ির চাষিরা জানিয়েছে, বাতিল আলু জ্যোতি আলুর বর্তমান বাজার দরে, কোনো কোনো ভেন্ডার কিনে নিচ্ছে। কিন্তু অন্য জেলার চাষিরা জানিয়েছে, চুক্তি চাষের বাতিল আলু ভেন্ডাররা সবসময় নেয় না। বাজারেও বিক্রি হয় না। সেগুলি তখন গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

এবার হিসেবটা করে ফেলা যাক। জ্যোতি আলুর ক্ষেত্রে এখন বাজার দর প্রতি কুইন্ট্যাল ৫০০ টাকা। বিঘায় উৎপাদন ৪০ কুইন্ট্যাল। এই হিসেবে চাষি আলু বিক্রি করে পাচ্ছে ২০ হাজার টাকা। কিন্তু তার খরচ হয়েছে ২৩ হাজার টাকা। তাহলে লোকসান হচ্ছে ৩ হাজার টাকা।

আর চুক্তির আলু চাষে বিঘার মোট উৎপাদন ৩০ কুইন্ট্যাল এর মধ্যে ঠিকঠাক মাপের ২৫ কুইন্ট্যাল আলু বিক্রি হচ্ছে ৯৪০ টাকা দরে। এতে চাষি পাচ্ছে ২৩৫০০ টাকা। এছাড়া ধরে নেওয়া গেল মাপের বাইরের আলু সব ভেন্ডারই কিনে নিচ্ছে ৫০০ টাকা কুইন্ট্যাল দরে। সেক্ষেত্রে বাকি ৫ কুইন্ট্যাল আলু থেকে পাওয়া যাবে আরো ২৫০০ টাকা। অর্থাৎ মোট আয় ২৬ হাজার টাকা। এর থেকে চুক্তির চাষের মোট খরচ বা ১৯ হাজার ৫০০ টাকা বাদ দিলে বিঘায় লাভ হচ্ছে ৬৫০০ টাকা।

এবারে আসা যাক গত বছরের হিসেবে। দৈনিকটির তথ্য অনুযায়ী গতবার চুক্তির আলু কুইন্ট্যাল প্রতি ৯৩০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু চাষিরা বলেছে সর্বোচ্চ ৮৫০ টাকা কুইন্ট্যাল দরে ভেন্ডাররা আলু কিনেছিল। তবে এখানে ৯৩০ টাকা দর ধরেই এগোনো যাক। এই হিসেবে ২৫ কুইন্ট্যাল আলু ৯৩০ টাকা দরে বিক্রি করে চাষি পেয়েছে ২৩২৫০ টাকা। আর বাতিল ৫ কুইন্ট্যাল আলু বিক্রি হয়েছে ৫০০ টাকা দরে। এতে পেয়েছে ২৫০০ টাকা। সব মিলিয়ে আয় চাষির ২৫৭৫০ টাকা। অন্যদিকে গত বছর বীজের দাম ছিল ১২০০ টাকা বস্তা। আর বিঘা প্রতি চাষের খরচ ছিল ১৬৫০০ টাকা। ফলে এক বিঘা চুক্তির আলু চাষে লাভ হয়েছিল ৯২৫০ টাকা। 

দৈনিকটির হিসেবে জ্যোতি আলুর এক কুইন্ট্যালের দাম গতবারে ছিল ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা। কুইন্ট্যাল প্রতি ১২০০ টাকা হিসেব ধরলে ৪০ কুইন্ট্যালের দাম হয় ৪৮ হাজার টাকা। গতবারে জ্যোতি আলুর বীজের সর্বাধিক দাম ছিল ১৬০০ টাকা বস্তা। এই হিসেবে বীজের জন্য খরচ হয়েছিল ৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ এবারের থেকে ৮৫০০ টাকা কম। ফলে বিঘা প্রতি চাষের খরচ হয়েছিল ১৪৫০০ টাকা। চাষির লাভ হয়েছিল বিঘায় ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা।

বোঝা যাচ্ছে চুক্তির আলু চাষে প্রতি বছরই অল্প হলেও লাভ হচ্ছে। আর সাধারণ আলু চাষে কখনো প্রচুর লাভ হচ্ছে। আর উৎপাদন বেশি হলে লোকসানও হচ্ছে। তাহলে কেন বেশিরভাগ চাষি চুক্তি চাষ করছে না? অথবা যারা চুক্তির আলু চাষ করছে, তারাই আবার অন্য জমিতে জ্যোতি, পোখরাজ আর চন্দ্রমুখী আলু চাষ করছে কেন?

সাধারণভাবে এই প্রশ্নের উত্তরে চাষিরা বলছে,

আলুর বাজার তো এখন সারা বছর জুড়ে। দামও কিছু কিছু করে বাড়তে থাকে বেশিরভাগ বছরে। ফলে লোকসানের বহর কমে যায়। লাভও হয়ে যেতে পারে। এজন্য হিমঘরে রাখতে হবে। তাই আরো বেশি হিমঘর হলে চাষির সুবিধা হয়।

এটা ঠিকই দু-তিন বছরে এক-আধবার লোকসান হয়। সে তো সব ক্ষেত্রেই হয়। তাতে কি লোকে কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে বসে থাকে নাকি? যে জমিতে আলু চাষ হয় সেখানে সাধারণভাবে বছরে তিনবার চাষ হয়। ফলে কোনো ফসলে লোকসান আবার কোনো ফসলে লাভ – এইভাবেই চলছে।

চিপস ছাড়া আপনি চুক্তি চাষের আলু খেয়েছেন কখনো? ঘাস না আলু বুঝতে পারবেন না। চাষি আর তার পরিবার তো খাবে?  যারা চাষ করে না তারাও তো খাবে। সারাদিন তো চিপস খাবে না। তাই মিলিয়ে মিশিয়েই চাষ হয়।

সবাই চুক্তি চাষ করলে খাওয়ার আলু কে চাষ করবে? আর ভেবে দেখুন, সব চাষি চুক্তি চাষ করলে তো আমরা কোম্পানির চক্করে পড়ে যাব। তখন সুযোগ বুঝে তারা দাঁও মারবে না, এর কোনো গ্যারান্টি আছে? চাষিরা কি এতটাই নির্বোধ?

এই জবাবের পর আর কোনো কথা থাকতে পারে বলে অন্তত আমার মনে হয় না।

 

* বিভিন্ন জেলার আলু চাষিদের সঙ্গে কথা বলে এইসব হিসেব পাওয়া গেছে। 

 

পুনশ্চঃ  চুক্তি ছাড়া আলু চাষের লাভক্ষতির হিসেব ২২-২৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে চাষিদের সঙ্গে কথা বলে করা হয়েছিল। এখন লেখাটি প্রকাশের সময়ে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ৩৮০ টাকা থেকে ৪২০ টাকার মধ্যে ৫০ কেজির বস্তা বিকোচ্ছে। অর্থাৎ এখনই আলু চাষে চাষি লাভের মুখ দেখছে। তবে একটা কথা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, শুধু বাজারের সাময়িক দাম ধরে লাভ ক্ষতির হিসেব করা সব সময় কাজের নাও হতে পারে।

সুব্রত কুণ্ডু

 মার্চ - ২১ ২৬-২০, কৃষি, বাজার

Comments

Popular posts from this blog

লিঙ্গসাম্যের দিকে এগোচ্ছে দেশ

পারম্পরিক জ্ঞানের তথ্যায়ন

দাঁতের ব্যথায় লবঙ্গ