পারম্পরিক জ্ঞানের তথ্যায়ন

খাদ্য স্বয়ম্ভরতা, প্রকৃতিমুখী জীবিকা, জীবনভর শিক্ষা, সবার সুস্থতা, সুস্থায়ী আবাস সর্বোপরি সার্বিক কল্যাণের কাজ করতে হলে, পারম্পরিক জ্ঞানের তথ্যায়ন খুবই জরুরি লিখছেন সুব্রত কুণ্ডু

মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ অঞ্চলের ভান্ডারা এবং গোন্দিয়া জেলায়, জেলেরা মিঠে জলের মাছ কালভালির পেটে ৪ সেন্টিমিটার লম্বা কমলা রেখা খোঁজে, বর্ষার আগে। এই কমলা রেখা দেখা যায় তাদের প্রজননের সময়।পারম্পরিক এই জ্ঞান শুধু জেলেদের কাজে লাগে তাই নয়। চাষিদের কাজেও লাগে। কারণ মাছের পেটে কমলা রেখা দেখা দেওয়ার অর্থ— বর্ষা আসতে আর মাত্র ৬-৭ দিন দেরি। চাষিরা এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তাদের চাষের পরিকল্পনা করে।

এটা কোনো গল্প কথা নয়। বহুদিন ধরে এখানকার জেলে এবং চাষিরা এই পারম্পরিক জ্ঞান ব্যবহার করে চলেছে। শুধু এখানে নয়, সর্বত্রই গ্রামীণ মানুষদের কাছে রয়েছে এরকম অফুরান জ্ঞান— যা তাদের জীবন জীবিকার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জুড়ে আছে। খাদ্য স্বয়ম্ভরতা, প্রকৃতিমুখী জীবন জীবিকা, জীবনভর শিক্ষা, সবার সুস্থতা, সুস্থায়ী আবাস এবং সর্বোপরি গ্রামীণ মানুষের সার্বিক কল্যাণের জন্য, এই পারম্পরিক জ্ঞানের তথ্যায়ন বা ডকুমেন্টেশন খুবই জরুরি একটি কাজ। এই তথ্য আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে জুড়ে কাজ করতে সাহায্য করে।

পারম্পরিক জ্ঞান মূলত, মুখে মুখে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে বাহিত হয়। কিন্তু বর্তমান উন্নয়নের ধারায় এসবের গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। ফলে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এই অমূল্য সম্পদ । ধরা যাক মাটির সামগ্রী তৈরির কথা। ধাতব এবং প্লাস্টিক সামগ্রীর দাপটে গ্রামে এখন কুমোর নেই। আর তাই কোন মাটি দিয়ে, কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করলে কোন পাত্র বা সামগ্রী শক্তপোক্ত হয়, সে জ্ঞানও হারিয়ে গেছে।

এর সঙ্গেই প্রায় হারিয়ে গেছে জীবনভর শিক্ষার সম্ভাবনাও। হারিয়ে যেতে বসেছে কুমোরের প্রকৃতিমুখী জীবিকা। হারিয়ে গেছে চাষিদের সঙ্গে কুমোরদের বিনিময়ের সম্পর্ক, যা উভয়ের খাদ্য স্বয়ম্ভরতাকে পরিপুষ্ট করত। শক্তিশালী করত স্থানীয় অর্থনীতিও।

এখানে চাষি এবং কুমোরের একটা সাধারণ সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু গভীরে গিয়ে যদি দেখা যায়, তবে বোঝা যাবে পারম্পরিক জ্ঞান হল, সমাজের ব্যবহারিক জ্ঞান। যা বার বার ব্যবহারের ফলে ক্রমশ শাণিত হয়। এই জ্ঞান প্রকৃতিমুখীও যা সংরক্ষণের কথাও বলে। 

এখন সর্বত্র বেচে খাওয়ার অর্থনীতির রমরমা। আর তাই দূষণ, জলবায়ু বদল, মহামারিরও রমরমা। গত পঞ্চাশ-ষাট বছরে এই অর্থনীতির দাপটে মানুষের অস্তিত্বই সংকটে। এখন বিকল্প চাই। বেঁচে থাকার অর্থনীতি চাই। চাই সংরক্ষণের উদ্যোগ।  

পারম্পরিক জ্ঞানের তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, তার প্রসার এবং ব্যবহারের ফলে গ্রামীণ মানুষের জীবিকার নিরাপত্তা, সংস্কৃতির সংরক্ষণ, বৈচিত্রের সংরক্ষণ আর সমাজের সার্বিক অগ্রগতি হতে পারে। তৈরি হতে পারে বেঁচে থাকার অর্থনীতি। সেই কারণেই পারম্পরিক জ্ঞানের তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, তার ব্যবহার এবং প্রসার খুবই জরুরি। 

জুলাই - ২৪, ৩০ - ০১, পরিকল্পনা, তথ্যায়ন


Comments

Popular posts from this blog

লিঙ্গসাম্যের দিকে এগোচ্ছে দেশ

দাঁতের ব্যথায় লবঙ্গ