জলবায়ু বদলে শিক্ষানাশ

পরিবেশ বিপর্যয়, বিশেষ করে জলবায়ু বদলের কারণে শিক্ষার প্রসার বাধা পাচ্ছে লিখছেন সুব্রত কুণ্ডু


তাপপ্রবাহের কারণে ২২ এপ্রিল থেকে স্কুলগুলিতে অতিরিক্ত ছুটি ঘোষণা করেছিল রাজ্য সরকার। এ বছর গরমের ছুটি ৫ মে থেকে শুরু হওয়ার কথা ছিল। অর্থাৎ বেশ কিছু দিন ধরে, বিশেষ করে, প্রাথমিক স্তরে পঠনপাঠন বন্ধ থাকবে। গত বছরও একই ঘটনা ঘটেছিল। সারা রাজ্যে গরমের জন্য আগেই স্কুল ছুটি দিয়ে দেওয়া হল। প্রবল বিতর্ক হল। কারণ দক্ষিণবঙ্গে গরম থাকলেও সে সময় উত্তরবঙ্গের অনেক জায়গায় আগাম বৃষ্টির কারণে আবহাওয়া গরম ছিল না।

বিতর্ক যাই হোক না কেন? পরিবেশ বিপর্যয়, বিশেষ করে জলবায়ু বদলের কারণে শিক্ষার প্রসার বাধা পাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের একটি নতুন পলিসি নোটে এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন সাম্প্রতিক প্রমাণ সহযোগে সেখানে জানানো হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে শিক্ষার প্রসারে বাধার সৃষ্টি করছে। যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন বিপর্যয়ের কারণে অতিরিক্ত দিন স্কুল বন্ধের ঘটনা— যা এই নিবন্ধের শুরুতেই বলা হয়েছে।

শিক্ষা বিষয়ক এক কেন্দ্রীয় সরকারি নোটে বলা হয়েছে, গত ২০ বছরে প্রায় ৭৫ শতাংশেরও বেশি স্কুল চরম আবহাওয়া এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে বন্ধ ছিল। এই সব ঘটনা ৫০ লক্ষেরও বেশি পড়ুয়াকে প্রভাবিত করেছিল। শুধু তো পড়ুয়া নয়। এর ফলে তাদের পরিবারও প্রভাবিত হয়েছিল। সব থেকে বেশি প্রভাব পড়েছিল, প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া এবং তাদের পরিবারে। অনেক শিশু স্কুলছুটও হয়ে পড়েছিল পরিবেশ বিপর্যয়ে।

তাপপ্রবাহ, বন্যা, পরিবেশ দূষণ এবং এর মতো কারণে, ভারতের মতো বিকাশশীল দেশে এক বছরে একাধিকবার স্কুল বন্ধ করা এখন সাধারণ ব্যাপার। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের খড় পোড়ানোর ফলে— দূষণের কারণে প্রতি বছরই দিল্লির স্কুল কিছু দিন বন্ধ রাখতে হয়। খোদ রাজধানী দিল্লির যখন এই অবস্থা তখন সারা দেশের ছবি সহজেই অনুমান করা যায়।

জলবায়ু বদলের কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ে পড়ুয়াদের মনে চাপ, আশংকা, ভয় তৈরি করে। স্কুল না যাওয়ার কারণে তাদের আনন্দ, হাসি, মজার ঘাটতি হয়। ফলে তাদের মানসিক অবস্থা পরিবর্তন হয়। মনের বিকাশে প্রভাব পড়ে। পড়াশোনায় ক্ষতি হয়। এসব মিলিয়ে পড়ুয়াদের মনে নানা বিরক্তি তৈরি হয়। এর থেকে হিংসার জন্ম হয় শিশু মনে।

জলবায়ু বদলের কারণে শিক্ষা অর্জনে পড়ুয়ারা বাধা পেলে, তাদের ভবিষ্যতের আয় এবং উৎপাদনশীলতার উপরও প্রভাব পড়ে। দরিদ্র এবং নিম্নবিত্ত পরিবারে এর প্রভাব সব থেকে বেশি পড়ে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় দেখানো হয়েছে, যে স্কুলে পড়ার প্রতিটি অতিরিক্ত বছরে পড়ুয়ার আয় মোটামুটি ১০ শতাংশ করে বাড়ে। যেহেতু জলবায়ুর ধাক্কা শিক্ষা অর্জনকে হ্রাস করে। তাই ভবিষ্যতের এই উপার্জন করার সম্ভাবনাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিবারগুলির দারিদ্র্যকে স্থায়ী করে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের আর্থিক উন্নতি বাধা পায়।

এই সব ক্রমশ বেড়ে চলা নেতিবাচক প্রভাবগুলি সত্ত্বেও, জলবায়ু বদল হতেই থাকবে এটা ধরে নিয়ে, তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা বেশিরভাগ রাষ্ট্র এবং নীতিকারেরা করছে না। বিশ্বব্যাংকের মতে, তারা এর প্রয়োজনীয়তাকে পুরোপুরি উপলব্ধি করছে বলে মনে হয় না। এই সমীক্ষায় ২৮টি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের ৯৪ জন শিক্ষা বিষয়ক নীতিকারদের কাছে এ নিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে ৬৫ জন বলেছে, দেশের মোট ১০টি অগ্রাধিকারের শেষ তিনটির মধ্যে রয়েছে জলবায়ু বদল থেকে শিক্ষার সুরক্ষা বিষয়টি। পড়ুয়াদের শিক্ষার সুবিধা তাই দেশে দেশে ক্রমশ নিম্নগামী।

সমীক্ষাটিতে প্রস্তাব করা হয়েছে, জলবায়ু বদলের সঙ্গে শিক্ষাকে খাপ খাইয়ে নিতে চারটি ক্ষেত্রে কাজ করতে হবে। এগুলি হল, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, স্কুল অবকাঠামো, পরিবর্তন কর্মী হিসাবে ছাত্র এবং শিক্ষকের ব্যবহার এবং শেখার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা। বিশ্বব্যাংকের এই সমীক্ষায় উঠে এসেছে, গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশগুলিতে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বছরে প্রায় ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারের সমতুল ক্ষতি হয়। ভারতীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা। এতো গেল শুধু ঘুর্ণিঝড়ের কথা। জলবায়ু বদলের কারণে ক্রমবর্ধমান খরা, অতিবৃষ্টি, বন্যা, মহামারি, ভূমিকম্পে আরো অনেক ক্ষতি হয়। এই সমীক্ষায় বলা হয়েছে— বন্যা, ঘুর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টির কারণে প্রতিবছর প্রায় ১০ হাজার স্কুলের ক্ষতি হয়।

সমীক্ষাটিতে প্রস্তাব হিসেবে তাই বলা হয়েছে, আগামী ৫০ বছর ধরে, প্রতি বছর যে লক্ষ লক্ষ পড়ুয়া স্কুলে আসবে তাদের শিক্ষার কথা মাথায় রাখতে হবে। আর সেই কারণে জলবায়ু বদল এবং পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার সক্ষমতা বাড়াতে হবে সব দেশগুলিকে। এ জন্য এখন থেকেই সরকারগুলিকে পরিকল্পনা নিতে হবে। এছাড়া জলবায়ু বদল প্রশমনের জন্য আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী কার্বন ডাই অক্সাইডসহ সমস্ত গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর জন্য উদ্যোগও নিতে হবে।          মতামত নিজস্ব

মে - ২৪, ২৯-৭০, জলবায়ু বদল, শিক্ষা 

Comments

Popular posts from this blog

রক্তচাপ কমায় টম্যাটো

সার থেকে ক্যান্সার

আচ্ছে দিন