জ্বর হয়েছে পৃথিবীর!

জ্বরে ক্রমশ কাবু হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী লিখছেন সুব্রত কুণ্ডু


গত শতাব্দীতে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি বেড়েছে। শুনে মনে হতেই পারে, ১ ডিগ্রিই তো বেড়েছে!  এ নিয়ে এত বিপদ বিপদ করার কি আছে! এখন হামেশাই জ্বর হলে শরীরের তাপ ২ ডিগ্রি ফারেনহাইট বেড়েই যায় আবার কমেও যায়!

ঠিকই। তবে এটা তো মানবেন, জ্বর রোগ নয়। রোগের উপসর্গ মাত্র। যে কোনো কারণে জ্বর হতে পারে। তবে যে জ্বর দিনের পর দিন, মাসের পর মাস টিকে থাকে; যে জ্বরে শরীরের তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকে - তা নিয়ে ভাবতে হয় বৈকি!

পৃথিবীরও জ্বর হয়েছে। ক্রমশ বাড়ছে তার তাপমাত্রা। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই শতাব্দীর শেষে পৃথিবীর মোট তাপমাত্রা আরো ১.৫-২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। কেন এতটা বাড়বে? কারণ জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাস খুবই বাড়ছে। এই গ্যাসগুলি হল, কার্বন ডাই অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, মিথেন, জলীয় বাষ্প ইত্যাদি। বায়ুমণ্ডল জুড়ে গ্রিন হাউস গ্যাসের ঘন আবরণ তাপকে আটকে, গোটা পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর জন্য বরফ গলে জল হয়ে যাচ্ছে।

পৃথিবীর জ্বরের ফলে, হিমবাহ গলে যাচ্ছে। জৈববৈচিত্র কমছে। উদ্ভিদ ও প্রাণীর তাদের বাসস্থান পরিবর্তন করে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। সমুদ্রের জল তলের উচ্চতা বাড়ছে। বাড়ছে শক্তিশালী ঢেউয়ের পরিমাণ। লু বা তাপপ্রবাহ বাড়ছে। ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি এবং সংখ্যা– দুই বাড়ছে।

নানারকম গ্যাসের মিশ্রণে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল তৈরি হয়েছে। এরমধ্যে কয়েকটিকে গ্রিন হাউস গ্যাস বলা হয়। কারণ এই গ্যাসগুলি সূর্য থেকে আসা তাপ আটকে রেখে পৃথিবীকে গরম রাখে। এই উষ্ণতা প্রাণের সৃষ্টি এবং বেঁচে থাকার জন্য খুবই দরকার। এরকম যদি না হত, তাহলে এই গ্রহ বিশাল বরফের গোলায় পরিণত হত। এতে প্রাণ থাকত না।

বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাসগুলির মধ্যে বেশি থাকে জলীয় বাস্প আর কার্বন ডাই অক্সাইড। ভূমি, সমুদ্র এবং বায়ুমণ্ডলের মধ্যে এই গ্যাসগুলির চক্রাকারে পরিবাহিত হয়। এজন্যই যুগ যুগ ধরে তৈরি হয়েছে গ্যাসগুলির সুক্ষ্ম ভারসাম্য। এই ভারসাম্য, প্রকৃতির মধ্যে প্রাণের বেঁচে থাকা এবং বসবাস করার মত তাপমাত্রা তৈরি করেছিল। কয়েক লক্ষ বছর অবধি এই ভারসাম্য বজায় ছিল। কিন্তু গত ১৫০ বছর ধরে এই ভারসাম্য ক্রমশ নষ্ট হয়ে চলেছে।

এই সময় থেকে আমরা ব্যাপক হারে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়াতে শুরু করি। এই জ্বালানিগুলি হল কয়লা, পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস। বহুযুগ ধরে, প্রাকৃতিক চক্রের মাধ্যমে, এই জ্বালানি তৈরি হয়েছিল। যার একটা বড় অংশ হল কার্বন। কিন্তু মানুষের সীমাহীন লোভের জন্য, এই জ্বালানির যথেচ্ছ ব্যবহারে বায়ুমণ্ডলে কার্বনের দ্রুত পরিমাণ বাড়তে শুরু করল। কার্বন বায়ুমণ্ডলে থাকা অক্সিজেনের সঙ্গে মিশে তৈরি হল কার্বন ডাই অক্সাইড। তাপমাত্রার যে ভারসাম্য বহু যুগ ধরে গড়ে উঠেছিল তা, নষ্ট হতে শুরু করল। যত বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে জমল হল, তত গরম হল পৃথিবী। পৃথিবীর জ্বর হল। দ্রুত জলবায়ু বদলে গেল।

এখন প্রশ্ন লাভ আর লোভের ‘উন্নয়ন’ প্রক্রিয়া পৃথিবীর জ্বর কি আদৌ কমাতে পারবে? সমস্ত রাষ্ট্রনায়ক মিলে হাজারো চুক্তি, প্রোটোকল স্বাক্ষর করছে। সভা, সেমিনার করছে কার্বন কমানোর জন্য। আর দেশে লাইসেন্স দিচ্ছে অবাধ বনধ্বংসের, কয়লা, তেল উত্তোলনের। সম্প্রতি আদিবাসীদের বনের অধিকার খর্ব করা, মাটি খুঁড়ে আরো বেশি কয়লা তোলার উদ্যোগ – এরকমই কয়েকটি উদাহরণ।

ভুলে যাবেন না, প্রাণ সম্পদে ভরপুর একটাই গ্রহের খবর আমরা এখনো অবধি জানি…

অগস্ট - ২২, ২৮-০৬, জলবায়ু বদল, কার্বন


Comments

Popular posts from this blog

লিঙ্গসাম্যের দিকে এগোচ্ছে দেশ

পারম্পরিক জ্ঞানের তথ্যায়ন

দাঁতের ব্যথায় লবঙ্গ