ছোটোদের পাশে দাঁড়াই

অর্থনীতির ফারাক থেকেই সামাজিক ফারাক। 
অর্থনীতির আর সামাজিক থেকেই রাজনীতির ফারাক। 
লিখছেন শুভেন্দু দাশগুপ্ত



নানা কারণে ‘ছোটো’ রা বেজায় মুশকিলে।
অনেক মাস ধরে করোনা অসুখে লোকজন ঘরের ভিতরে, বাইরে বেরচ্ছে কম।

অফিস, কারখানা বন্ধ করে রাখায়, বন্ধ হয়ে থাকায়, কাজে থাকা লোকেদের ছাঁটাই, মাইনে কমিয়ে দেওয়া হয়ে চলেছে। যারা বেচাকেনা করে রোজগার করে তাদের আয় নেমে গেছে, নেমে যাচ্ছে।

যারা লরি, বাস, টেম্পো, ট্যাক্সি, রিক্সা, অটো, টোটো চালিয়ে, সারিয়ে টাকা জোগাড় করতো, যাতায়াতের নিয়মকানুন, লোকজন, মালপত্তর চলাচলে নানা বাধা বানানোয় তাদের পাওনা গন্ডার হাল খারাপ।

যারা বাইরে, দূরে কাজ করে ঘরে টাকা পাঠিয়ে সংসার চালাতে গিয়েছিল, তারা কাজ হারিয়ে ঘরে ফিরে এসেছে, এসেও কিছু করতে পারেনি।

যারা দিন এনে দিন খায়, তাদের দিনের কাজ কমে গেছে, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, দিন আনা কমে যাচ্ছে, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

সব মিলিয়ে যে কথাটি, তা হলো আয় নেই, আয় কমে যাচ্ছে। আয় না থাকলে খাবার নেই, পড়বার কাপড় নেই, ওষুধ নেই, ছোটদের পড়াতে পাঠানো নেই, আরো বেশ কিছু নেই।

আমরা যারা, যাদের নাম ‘মধ্যবিত্ত’ মাঝারি, যাদের চাকরিটা এখনও রয়েছে, আয়টাও কমেনি, এই ‘মাঝারি’রা একটু ছোটোদের পাশে দাঁড়াই। ছোটোদের দিকে হাত বাড়াই।

কীভাবে
পাড়ার সবচেয়ে ছোটো মুদিখানা থেকে প্রতিদিনের সংসারে লাগা জিনিস কিনি। সবটা কেনা যদি মুশকিল হয়, যতটা পারা যায় ততটাই কিনি।

পাড়ার পাশে ছোটো বাজারটায় গিয়ে ছোটো সবজিওয়ালার কাছ থেকে সবজিটা কিনি। পাড়ায় রাস্তার ধারে বসা মুচির কাছে জুতোটা সারাই, অল্প দামের চটি, জুতো কিনি।

খাবারের দরকার পড়লে পাড়ায় থাকা ছোটো খাবার দোকানে যাই।

জামা কাপড় সারাতে হলে পাড়ায় একটা সেলাই কল নিয়ে থাকা দর্জির কাছে যাই।

এভাবেই পাড়ায় পাড়ায় ফেরি করতে আসা ঝাড়ুওয়ালা, বালিশওয়ালার কাছ থেকে কিনে নেওয়া।

কোনো কিছু খারাপ হয়ে গেলে পাড়ার সবচেয়ে কাছের সরাইওয়ালাকে দিয়ে সারিয়ে নেওয়া। ব্যাগ, ছাতা, প্রেসার কুকার, টর্চ, পাখা, আলো, সাইকেল এমন সব টুকিটাকি।

আমার আর উদাহরণ জোগানের দরকার নেই। আমরা যে কেউ যে কোনো দিন আধঘণ্টা হেঁটে নিজের পাড়াটা, পাশের পাড়াটা ঘুরে এলে দেখতে পাবো কতো মানুষজন কত কাজে একটু রোজগার করে টিঁকে থাকার চেষ্টা করে চলেছে।

একদিন কাগজ আর কলম নিয়ে বেরলে একটা তালিকা বানিয়ে ফেলতে পারবো।

কেউ এখন প্রশ্ন করতে পারে এমনটা কেন করবো, করতে যাবো। আমার কী দায়!

আমার কথা, এমন প্রশ্নের উত্তর নিচে খুঁজলে নিজেই পেয়ে যাবো। পাবার কথাই।

অল্প কথায় বলা, আমার বেঁচে থাকার সাথে জড়িয়ে নেওয়া আমার থেকে যাদের হাল খারাপ তাদের। আমার অল্প আয়ের টাকা দিয়ে তো কিছু কিনতেই হচ্ছে, কিছু কাজ করাতে হচ্ছে। সেটা বড়োদের না দিয়ে ছোটোদের দিই। আমি বাঁচি ওরাও বাঁচুক।

আমার বাঁচা কীভাবে
আমার দরকার অল্প জিনিস, অল্প কাজ, অল্প দামে পাওয়া।

যারা আমাকে জিনিস দেবে, আমার কাজ করে দেবে, তারা অল্প দামে দেবে। তারা জানে বেশি চাইলে তারা বেচতে পারবে না, কাজ করে দেওয়া পাবে না।

আবার যারা এইভাবে ছোটোখাটো অল্প জিনিস বেচে, অল্প কাজ করে টিকে থাকবে, তারাও আবার তাদের মতন লোকেদের কাছ থেকে কিনবে, তাদের কাজ করিয়ে নেবে।

এইভাবে একটা 'ছোটোদের অর্থনীতি' তৈরি হবে, চলতে থাকবে, টিঁকে থাকবে।

এমন কথা বলা কেন
এখন ছোটোদের অর্থনীতিতে, আয় করায়, খরচ করায় বড়োরা, বড়ো কোম্পানিরা ঢুকে যাচ্ছে, দখল করে নিচ্ছে, ছোটোদের সরিয়ে দিচ্ছে।

বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া, দাম কমিয়ে জিনিস বেচার গপ্পো বলা, দুটো কিনলে একটা ফ্রি লোভ দেখানো। আমরা 'মাঝারি'রা ওদের দিকে চলে যাচ্ছি।

ছোটোদের কাছ থেকে সরে যাচ্ছি।

এবার আমরা একটু সচেতন হই।

ছোটোদের পাশে থাকি।

অর্থনীতির যেসব হিসেবপত্র কাগজে বেরচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে বড়োরা আরো বড়ো হয়ে চলেছে। ছোটোরা আরো ছোটো হয়ে যাচ্ছে।

বড়োদের সাথে ছোটোদের ফারাক বেড়েই চলেছে।

এই বিষয়টা শুধুই যে অর্থনীতি দিয়ে বোঝার তা নয়। অর্থনীতির বাইরে গিয়ে সমাজ দিয়ে, রাজনীতি দিয়ে বোঝার।

অর্থনীতির ফারাক থেকেই সামাজিক ফারাক। অর্থনীতির আর সামাজিক থেকেই রাজনীতির ফারাক।

দেশের অর্থনীতি থেকে, সমাজ থেকে এই সব অল্প আয়ের, আয় না থাকা মানুষরা মুছে যাবে। অন্যভাবে বলা যেতে পারে, তাদের মুছে দেওয়া হবে।

এই লেখাটা একটা প্রাথমিক খসড়া। নানা জনের উদাহরণ দেওয়ায়, মতামত যোগে লেখাটা বাড়তে থাকুক। যে যার নিজের এলাকা দিয়ে, নিজেদের চোখে দেখা দিয়ে, মাথার ভাবনা দিয়ে লেখাটাকে এগিয়ে দিক।

লেখাটা সবার লেখা, সবার জন্য সবার লেখা, সবার ভাবার জন্য, সবারই কিছু করার জন্য লেখা হয়ে উঠুক।

ডিসেম্বর -২১, ২৭- ৩৭, অর্থনীতি, ছোটো ব্যবসা

Comments

  1. ভীষণ ভাবে প্রভাব পড়ল চিন্তা ও চেতনার মানচিত্রে ।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

রক্তচাপ কমায় টম্যাটো

সার থেকে ক্যান্সার

আচ্ছে দিন